মো. আরিফুজ্জামান

  ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯

মতামত

টেকসই উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা

প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলেমেয়েদের অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি এবং সমতা তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। প্রাথমিক শিক্ষার সফলতার দিকগুলো হলোÑ শতভাগ শিশুর প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া, শ্রেণিকক্ষে লৈঙ্গিক সমতা প্রতিষ্ঠা এবং অতি উচ্চহারে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করা। এ ধারাকে অব্যাহত রাখতে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে মানসম্মত শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। গুণগত ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা-পরবর্তী শিক্ষার মূল ভিত্তি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত দেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তির ওপর নির্ভর করে পছন্দমতো পরবর্তী শিক্ষার ধারাকে বেছে নেয়। কারিগরি, বিজ্ঞান, কলা বা বাস্তবমুখী শিক্ষার মাধ্যমে তারা নতুন প্রজন্মকে আগামী দিনের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। বাস্তব এ চিত্র সামনে রেখেই বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে সার্বিক প্রয়াস চালাতে হবে।

টেকসই উন্নয়নের মূল বৈশিষ্ট্য হলোÑ No one left behind। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ১৭টি অভীষ্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ১৭টি অভীষ্ট/লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও ২৩২টি পরিমাপক রয়েছে। যার মধ্যে ৪ নম্বর অভীষ্ট হলোÑ মানসম্মত শিক্ষা (অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা)। এই লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। যেমনÑ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদরাসাভিত্তিক ইবতেদায়ি ও কওমি শিক্ষাব্যবস্থা এবং এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা, বেসরকারি ও প্রি-ক্যাডেট প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। প্রণিধানযোগ্য যে, টেকসই উন্নয়নের জন্য গুণগত শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার শুরুটা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার শুভসূচনা করেছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একযোগে জাতীয়করণ করেন। এ ছাড়া কয়েক শ ইবতেদায়ি মাদরাসাকে এমপিওর আওতায় আনয়ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত আরো পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে তিন দফার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি। এ কর্মসূচিতে বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে রঙিন বই হাতে তুলে দেওয়া, উপবৃত্তি কার্যক্রম, সরকারি বিদ্যালয়ে দফতরি কাম প্রহরী নিয়োগ, স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন প্রভৃতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টসহ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের পাঠ প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শিক্ষকদের নতুন পদ সৃষ্টিসহ বিপুলসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালুকরণসহ শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে; যা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবস্থাকরণ, ডিজিটাল হাজিরার প্রচলন করা হয়েছে। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় গমনোপযোগী প্রায় শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি সম্ভব হয়েছে। প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (পিইডিপি-৩)-এর আওতায় সারা বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের নতুন ভবন নির্মাণসহ ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে।

প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গমনোপযোগী দেশের সব শিশুকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে স্কুল মিলনীতির আওতায় নিয়ে আসতে অতি সম্প্রতি ‘জাতীয় স্কুল মিলনীতি ২০১৯’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ নীতিমালার আলোকে ১ কোটি ৪০ লাখ শিশুকে স্কুল মিলের আওতায় আনা হবে মর্মে ধারণা করা হচ্ছে। ক্লাসসমূহে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান, স্কুল মিল চালুকরণ, স্কুল ড্রেস প্রদান ও উপবৃত্তি প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এ কার্যক্রম শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিসহ গ্রাম ও শহর, ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে শিক্ষার মানের ব্যবধান কমাতে সাহায্য করছে। যার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অভীষ্ট-৪-এর প্রতিশ্রুতি মানসম্মত শিক্ষা (অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা) নিশ্চিত করতে সরকার সক্ষম হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর পরিচালিত বার্ষিক প্রাথমিক স্কুল জরিপ তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ, ২০০৬ সালে ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৫০ দশমিক ৫, ২০১০ সালে ৩৯ দশমিক ৮, ২০১২ সালে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। সবশেষ ২০১৮ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এসব জরিপ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক দশকে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অর্ধেকেও বেশি কমে এসেছে। মূলত শেখ হাসিনা সরকারের সময়োপযোগী নানা পদক্ষেপের কারণে এই সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে। সমৃদ্ধ ও উন্নত আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চায় সরকার।

প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় বাধাসমূহের মধ্যে প্রথমত. বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন, গুণগত মানোন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনে মূল সমস্যা হলো ক্ষুধা ও অপুষ্টি। পেটে ক্ষুধা নিয়ে একটি শিশু কখনো পড়াশোনায় ভালোভাবে মনোযোগ দিতে সক্ষম হয় না। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়মিত স্কুলে উপস্থিতি নিশ্চিত করা একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যার কারণ দরিদ্রতা, স্বাস্থ্যহীনতা, স্কুলভীতি ও অভিভাবকদের অসচেতনতাকে মূলত দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তৃতীয়ত. যুগোপযোগী ও মানসম্মত পাঠদান পদ্ধতির অভাব। যুগোপযোগী ও মানসম্মত পাঠদানের অভাবে কাক্সিক্ষত পর্যায়ের ফলাফল ও শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চতুর্থত. শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের বিকাশে অভিভাবক ও শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টিকে অনেক ক্ষেত্রে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণের পরিবর্তে তাদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করছে। পঞ্চমত. প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শিশুবান্ধব পরিবেশ ও অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। ষষ্ঠত. প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সচেতন সমাজের দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা-২০১৯ অনুযায়ী ‘৩ থেকে ১২ বছর বয়সি শিশুদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদার ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে নিশ্চিত করা হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ মানসিক বিকাশ দ্রুত সাধিত হবে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সরকার শিক্ষকদের মাধ্যমে হোমভিজিট, ডিজিটাল হাজিরা, উপবৃত্তি প্রদান এবং ক্লাসসমূহকে আনন্দদায়ক করাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিতকল্পে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি আরো সময়োপযোগী কার্যক্রম গ্রহণের অবকাশ রয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকাভিত্তিক শিশু জরিপপূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা, নিয়মিত মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, হোম ভিজিট কার্যক্রম, বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ ও উপবৃত্তি প্রদান কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক গুণগত মানোন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধন। যা যথাযথভাবে বাস্তবায়নকল্পে শিক্ষা বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষক-অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকল্পে এসএমসি কমিটির নিয়মিত সভা আয়োজন করা যেতে পারে।

সর্বোপরি বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলছে, তখন আমাদের এ উন্নয়নকে টেকসই ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে প্রাথমিক শিক্ষাকেও তার স্বগতিতে এগিয়ে নিতে হবে। যার মাধ্যমে আমরা আগামী প্রজন্মকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলা উপহার হিসেবে দিতে সক্ষম হব।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী অফিসার

উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close