শতাব্দী জুবায়ের

  ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

জানতে দিন বীরাঙ্গনার ইতিহাস

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পকিস্তানি হানাদাররা বাঙালি নারীদের ওপর চালিয়েছিল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের ক্ষত শুকায়নি এখনো। এখনো অনেক নারী এই ক্ষত বহন করে বেড়ান। হানাদাররা যে অমানবিক পাশবিক নির্যাতন করেছে, সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম নির্মম অত্যাচারের চিত্র পাওয়া দুষ্কর। এমনই নির্যাতন করা হয়েছিল আমার মা, বোনদের ওপর। বাংলাদেশের এমন কোনো এলাকা নেই, যে এলাকায় মেয়েদের সম্ভ্রম লুণ্ঠনের চিত্র পাওয়া যাবে না। হিন্দু, মুসলিম, বিবাহিত অথবা অবিবাহিত, বাঙালি আদিবাসী সব ধরনের বাঙালি নারীই মানবরূপী এই দানবদের লালসার শিকার হয়েছিলেন। তাদের এই লালসার ফল হিসেবে আমার মা-বোনরা অনেকেই গর্ভসঞ্চারিত হয়েছিলাম। তারা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। এই সন্তানদের আমরা বলে থাকি যুদ্ধশিশু। আর নির্যাতিত নারীদের বলে থাকি ‘বীরাঙ্গনা’। বীরাঙ্গনা কোনো নেতিবাচক শব্দ নয়। এর অর্থ বীর নারী। যে নারী বীরত্বের কাজ করে তাদের এই নাম দেওয়া হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার এই নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছেন। তাদের গর্বিত করেছেন, করেছেন সম্মানিত। তাদের পরিচয় দিয়েছেন।

কিন্তু বীরাঙ্গনাদের জীবনের গল্প আমরা ইতিহাসে কতটুকু স্থান দিতে পেরেছি। যদি ইতিহাসে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্থান যথার্থভাবে না দেওয়া হয় তাহলে নতুন প্রন্মের যারা তারা জানবে কী করে সত্যিকার কাহিনি। কী ঘটেছিল তাদের সঙ্গে? এটা লজ্জার কোনো বিষয় নয়। একটি দেশ অন্যায় আর শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য লড়াই করেছিল। সেই লড়াইটা বীরাঙ্গনারাও করেছিলেন। তারাও যোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন। তারা করেছেন শারীরিকভাবে। নির্মমভাবে তাদের ওপর চড়াও হয়েছিল হায়েনারা। তারা যে কী ধরনের অত্যাচার করেছিল, সেটাই জানানো দরকার তরুণ প্রজন্মকে। যদি সত্যিই প্রগতিশীলতার চিন্তাচেতনার অধিকারী করে নতুন প্রজন্মকে তৈরি করতে চান। যদি দেশের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ জাগাতে চান; তাহলে সত্যিকার ঘটনাটাই উপস্থাপন করতে হবে তাদের কাছে। না হলে জানোয়ারদের প্রতি ঘৃণা জন্মাবে কেমন করে?

ছোট একটা উদাহরণ দিচ্ছিÑ গত সত্তর বছরে জার্মানিতে নাৎসিদের অত্যাচারের সুশৃঙ্খল প্রামাণ্য তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে সে দেশে। তার ওপর নির্ভর করে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিহাস লেখা হয়েছে। কোনো প্রজন্মকে ভুলতে দেওয়া হয়নি নাজি বা ফ্যাসিস্টদের অত্যাচারের কথা। যে কারণে পাশ্চাত্যে নাজি বা ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়নি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস অনেকটাই অজানা। নারীরা অত্মসম্মানের ভয়ে এটা বলতে চাননি। অথবা ইতিহাসবিদরা ও গবেষকরা এ বিষয়ে বেশি একটা কাজ করেননি। তবে এটার ওপর সরকারিভাবে প্রচুর কাজ করা উচিত। বেশি দিন হয়নি আমাদের মধ্য থেকে গত হয়েছে বীরাঙ্গনা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। একজন সাহসী বীরাঙ্গনা। যিনি নিজে বুক ফুলিয়ে এসব বলেছেন। অন্য নারীদেরও তা প্রকাশ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি সাহস জুগিয়েছিলেন নির্যাতনের শিকার নারীদের। অগ্রপ্রতীক ছিলেন তাদের। আমাদের বীরাঙ্গনাদের। তিনি নিজে রক্ষণশীলতাকে ভেঙে প্রাপ্য সম্মান অর্জনে সোচ্চার ছিলেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাস পড়লে বোঝা যায়, আমাদের সমাজকে বীরাঙ্গনারা কত অবহেলিত ছিলেন। যদিও ইতিহাস বেশি একটা নেই। হয়তো বীরাঙ্গনাদের কোনো পরিবার মেনে নিয়েছে। কিন্তু তখনই সমাজ মেনে নেয়নি। আবার সমাজ মেনে নিলে পরিবার মেনে নেয়নি। ফলে পরিবার এবং সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে আমাদের বীরাঙ্গনারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন। তার খবর কি আমরা রেখেছি। তাদের বীরাঙ্গনা হওয়ার পেছনে যে কত নির্মম গল্প রয়েছে। সেটা কি একবার চিন্তা করে দেখেছি। এই বীরাঙ্গনারাই পরিবার অথবা সমাজে নিগৃহীত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আমরা চাই, দেশবাসী সত্য ঘটনাটাই জানুক। কেমন শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাদের সময় অতিবাহিত করেছেন। এই সত্যটা জানলেই মনে হয় আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারব। আমাদের মা-বোনরা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন শুধু একটি স্বাধীন দেশের জন্য। বাংলা ভাষার জন্য। ওরা তো ইচ্ছা করে হানাদারদের সঙ্গে এমন কাজ করেনি। তাদের করতে বাধ্য করা হয়েছে।

বীরাঙ্গনাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মান দিয়েছিলেন। আমরাও জাতির জনককে অনুসরণ করে বীরাঙ্গনাদের এখন মা বলে ডাকি। তবে একটি কথা বলব, বীরাঙ্গনাদের তখনই সত্যিকার সম্মান করা হবে যদি তাদের নিয়ে গবেষণা করা হয়। তাদের সত্যিকার ইতিহাসটা তরুণ প্রজন্মকে জানানো হয়। তখন প্রজন্ম জানতে পারবে, একটি দেশ সৃষ্টি হওয়ার পেছনের সত্যিকার কাহিনি।

লেখক : শিক্ষার্থী

বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close