জাকির আজাদ

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

নিবন্ধ

যুগে যুগে শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিং

দেশের সব কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে প্রথম ভর্তির পরে প্রথম ক্লাসের দিন র‌্যাগিং হচ্ছে যুগ যুগান্তরে। তবে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যত্যয় রয়েছে। র‌্যাগিংয়ের প্রচলিত অর্থ ‘পরিচয় পর্ব’ অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নবীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রবীণ শিক্ষার্থীদের সখ্য গড়ে তোলার পরিচিত পর্ব। ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রাচীন গ্রিসে প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সিনিয়র ও জুনিয়র মধ্যে র‌্যাগিংয়ের প্রচলন ঘটে। সেই থেকে ক্রমে ক্রমে তার ধরন পাল্টাতে থাকে। বর্তমানে সিনিয়ররা জুনিয়রদের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা প্রয়োগ করাটাই হচ্ছে র‌্যাগিং।

বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাতে এর খারাপ প্রভাব বিস্তার করছে। কখনো কখনো র‌্যাগিংয়ে সহপাঠীদের দিয়ে চড়-থাপ্পড়-ঘুষি দেওয়া হয়। কিংবা কান ধরিয়ে দোতলা কলেজ থেকে নিচতলায় নামানো হয়। কেনো সময় অর্ধউলঙ্গ হয়ে নাচার ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। বিরোধিতা করার উপায় নেই। বলা হয়, বড় ভাইয়েরা কলেজ বড়-ছোটদের। তাই তাদের কথানুযায়ী সব পালন করতে হবে।

এই ব্যাপারে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. আহমেদ কবির বলেন, আমার জীবনেও র‌্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটছে। যদিও র‌্যাগিং একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবু এর বিপক্ষে যাওয়ার বা কঠোর হওয়ার অবকাশ নেই। যদিও ব্যাপারটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরোনো শিক্ষার্থীদের একটা সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা, সেটাকে র‌্যাগিং বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু পরিচয় পর্বটা আনন্দময় ও মজাদার করাতে র‌্যাগিং। মাত্রাতিরিক্ত না হওয়াই ভালো। আজকাল কলেজে বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয়গুলো র‌্যাগিং অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের প্রতিটি কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় ও পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজে র‌্যাগিংয়ের প্রচলন বিদ্যমান। র‌্যাগিং সম্পর্কে অনেকের মধ্যে মন্দ ধারণা থাকলেও আবার অনেকে বিষয়টাকে স্বাভাবিক ও আনন্দ-মজার একটা ঘটনা ভাবেন। কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের প্রবীণরা সাধারণত তাদের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের র‌্যাগ দেন। ব্যাচের পুরো শিক্ষার্থী সাধারণত র‌্যাগ দেন না। দেয় শুধু কিছু নির্ধারিত অগ্রজরা। বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজে প্রথম দিন আসার পরই র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়। তবে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে নিজ নিজ বিভাগীয় ক্ষেত্রে র‌্যাগিং বেশিই হয়ে থাকে।

র‌্যাগিং শুধু ছেলেদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। মেয়েদের বেলায় ঘটে থাকে। তবে সংখ্যাতীতভাবে মেয়েদের কম। র‌্যাগিংয়ের রয়েছে বিভিন্ন ধরন। এই ধরনগুলো সবই প্রায়োগিক, যেমনÑ পরিচয় দেওয়া, গান গাওয়া, নাচ করা, কবিতা আবৃত্তি করা, ক্যাম্পাসে ঊর্ধ্বশ^াসে দৌড়ানো, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন রয়েছে। সিনিয়র মেয়েদের প্রপ্রোজসহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন হয়ে থাকে। র‌্যাগিং সাধারণত একক কিংবা যৌথভাবে ঘটানো হয়ে থাকে।

র‌্যাগিংয়ের রকমফের ও ধরন নিয়ে প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, র‌্যাগিং (Ragging) যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবীণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নবীন শিক্ষার্থীদের একটা সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য পরিচিতি প্রথা। কিন্তু এই পরিচিতি প্রথাকে বিকৃত করে বিব্রত করা পরিস্থিতি উদ্ভব ঘটানো হচ্ছে। তা ছাড়া অনেক সময় লক্ষ্য করা গেছে, একজন ভালো শিক্ষার্থী ছিলেন কিন্তু কলেজে এসে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছেন। পরীক্ষায় খারাপ করছেন। অথবা পড়াশোনা ছেড়েই দিয়েছেন; কিংবা আত্মহত্যার মতো ব্যাপার ঘটানোর পর্যায়ে চলে গেছে। এর কারণ হতে পারে র‌্যাগিং যা তিনি মানসিকভাবে দৃঢ়তা অর্জন করতে পারেননি। তাই সচেতন হতে হবে। আনন্দ প্রকাশে কান্ডজ্ঞান বজায় রেখে র‌্যাগিংয়ে যেতে হবে।

একজন শিক্ষার্থী কলেজ জীবনে ঢুকে স্বাভাবিকভাবে অনেক কিছুই অজ্ঞাত থাকে। পরিচিতি ও পারিবারিক গন্ডি থেকে একটা নতুন জগতে প্রবেশ ঘটে। তার অচেনা জগৎটা চেনার আগে যাতে সিনিয়রদের মান্য করবে যথাযথ তাই সিনিয়র থেকে এমন বিড়ম্বনাময় পরিচিতি ঘটানো হয়। অর্থাৎ সিনিয়রদের সঙ্গে ভালো বোঝাপড়া করা। তবে র‌্যাগিংয়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলে সিনিয়রদের সঙ্গে যে সখ্যতগড়ে ওঠে তার ফায়দা হিসেবে পাওয়া যেতে পারে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের গাইডলাইন। পাওয়া যেতে পারে বিপদে-আপদে জরুরি প্রয়োজনে পাশে।

র‌্যাগিং কিছু সিনিয়র অনেক মন্দভাবে র‌্যাগ দিয়ে থাকেন, যা সম্পূর্ণ নোংরামিতে পরিপূর্ণ। অশ্লীল কথাবার্তা বলা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করা কিংবা শ্রবণ করা। কিছু কিছু র‌্যাগিং বর্বরতার রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। মাঝে মাঝে র‌্যাগিংয়ে নির্মমতা দেখতে পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, চরম নৈতিকতার অবক্ষয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠে পড়া গৌরবের হয়ে থাকে সেখানে কিছু কিছু সংকীর্ণমনা শিক্ষার্থী যৌনতা বিষয়কে প্রকাশ করে নীচু মানসিকতার পরিচয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে। তবে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা রয়েছে। যদি তা প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রশাসন। অনেক কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিংয়ের কারণে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। আসলে র‌্যাগিংয়ের কাছে জুনিয়রদের প্রতিবাদ করার কোনো ভাষা নেই। হয়তো কারো সেভাবে সুযোগ নেই। তাই বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।

পশ্চিমা সংস্কৃতির লেশমাত্রই হচ্ছে র‌্যাগিং। সময়ের গভীরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি অনিবার্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনিয়রের কাছে যেন র‌্যাগিং একটা নেশা। তা ছাড়া বরাবরই জুনিয়র থাকাকালীন সবাইকে র‌্যাগ সহ্য করতে হয়েছে। দেশের সবচেয়ে খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মেধাবী শিক্ষার্থীরাই র‌্যাগিং অনুশীলন করেন। এ ধরনের প্রথমসারির কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা জুনিয়রদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া জুনিয়র-সিনিয়র সম্পর্ক উন্নয়ন, মজা করা বা জুনিয়রদের আদব-কায়দা ও বিশ^বিদ্যালয়ের নিয়ম শেখানোর নামে র‌্যাগিং করে থাকেন। তবে বেশির ভাগ সময়ই নিছক মজার ছলে র‌্যাগিং শুরু হয়। তাই র‌্যাগিং মজার আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুকÑ এটা শিক্ষার্থীদের কাম্য হওয়া উচিত।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close