ইয়াসমীন রীমা

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বিনিয়োগ কমছে উপকূলীয় অঞ্চলে

বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার অধিকাংশই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। আগে যেখানে ১৫-২০ বছর অন্তর বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতো, বর্তমানে তা দু-তিন বছর অন্তরই হচ্ছে। গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্র্যাফট এবং জার্মান ওয়াচের তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপুর্ণ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণিঝড় সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯) এবং মহাসেন (২০১৩)-এর মতো শক্তিশালী ও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। তাছাড়া উপকূলীয় ভাঙন, বন্যা, জলাবদ্ধতা সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিসহ পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ভয়ংকর আকার ধারণ করছে; যা প্রতিনিয়ত উপকূলীয় এলাকায় মানুষের জীবনযাত্রা, অবকাঠামো, শিক্ষা, চিকিৎসা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ড ব্যাহত করছে।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের দুর্যোগপ্রবণ দেশসমূহের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মৃত্যুহার বৃদ্ধি ও জিডিপি হ্রাসের তুলনামূলক চিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় এবং বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, সাম্প্রতিক জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। বিআইএসআরের গবেষণায় দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নারীদের অভিযোজন কৌশলসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। এই কৌশলসমূহ সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনÑ উপাদানগত অভিযোজন, পদ্ধতিগত অভিযোজন ও মিশ্র অভিযোজন। এ প্রসঙ্গে বিআইএসআরের প্রধান নির্বাহী ড. খোরশেদ আলম বলেন, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, আগে যেখানে নারী শুধু গৃহস্থালি কাজ করতেন, কিন্তু এখন নারী পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন উপার্জনমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, নারী এখন মাটি কাটা, মাছের পোনা আহরণ, শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাড়ি-ঘরের আঙিনায় শাকসবজি চাষ, পান চাষ, কৃষিজমিতে সূর্যমুখী, ডাল, ভুট্টা, মটরশুটি ইত্যাদি চাষ, গৃহপালিত পশুপাখি পালন এবং সামাজিক বনায়নে সুবিধাভোগী হিসেবেও অংশগ্রহণ করছেন।

সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে প্রতি বছর উপকূলীয় এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, উপকূলীয় এলাকায় মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা দ্রুত আসছে না। তাছাড়া নারীর জন্য বিকল্প টেকসই কোনো কর্মেরও ব্যবস্থা নেই; যেখান থেকে তারা নিয়মিতভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এ ছাড়া যখন মাছ ধরার মৌসুম থাকে না, তখন পুরুষ বছরের বিরাট একটা সময় কোর বসে থাকছেন। ফলে ওই সময়ে নারী এনজিও হতে ঋণ নিচ্ছেন এবং পুরুষ দাদনদারদের কাছ থেকে সুদসহ টাকা ধার করছেন; যা পরবর্তীতে বছরব্যাপী পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে পারিবারিক কলহ ও পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিচ্ছে ছেলেমেয়েদের যৌতুকসহ বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে শিশুশ্রম। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার প্রসার। নারী ও শিশু যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।

ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাটর্নি ও ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্সের বৈশ্বিক পরিবেশে পরিবর্তন এবং মানবস্বাস্থ্য প্রকল্পের যুগ্ম চেয়ারম্যান জে ম্যাক মাইকেল পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার (পিএইচএফআই) নয়াদিল্লিতে প্রতিষ্ঠা দিবসের বক্তৃতায় বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সাগরের পানি বেড়ে যাবে এবং উপকূলীয় এলাকাগুলো প্রস্তাবিত হবে। যেহেতু ভারতের উপকূলরেখা দীর্ঘ; সেহেতু সেখানে এ প্লাবনের ফল হবে ভয়াবহ। সুপেয়পানি পাওয়া বিরাট সমস্যা হয়ে উঠবে এবং লোকজন নোনাপানি পান করবে। ভারতের উপকূলীয় এলাকাগুলো গর্ভবতী নারীর ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়বে। তিনি আরো বলেন, ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে জরিপ চালিয়ে দেখেন যে, সাগরের পানি বেড়ে যাওয়ায় সেখানে গর্ভবতী নারীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত সরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) কর্মরত পরিবেশবিজ্ঞানী রইস আক্তার বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বিভিন্ন ধরনের সমস্যাই দেখা দেবে। এ সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক একটি হচ্ছে অনাগত শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর এর অপপ্রভাব। আমাদের আগামী ভবিষ্যতের জন্য বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উষ্ণতা যে ঝুঁকি নিয়ে আসছে, তা মোকাবিলায় আগে তৎপর হতে হবে।

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close