ইসমাইল মাহমুদ

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

ইতিহাস

হানাদারমুক্ত মৌলভীবাজার

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে রক্তের সিঁড়ি বেয়ে বর্তমান মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, রাজনগর, কুলাউড়া ও বড়লেখা পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল। এর পূর্বে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের অমানবিক হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, জুলুম, রাহাজানি সহ্য করে এ অঞ্চলের বীর বাঙালিরা রক্তস্নাত যুদ্ধের মাধ্যমে ফিরে পায় বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।

শ্রীমঙ্গল : ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিলের পর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শ্রীমঙ্গলে শুরু করে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ। ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই ও ভারতের সীমান্ত থেকে মুক্তি বাহিনী ক্রমশ শ্রীমঙ্গল অভিমুখে এগিয়ে আসার খবরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভীত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ৬ ডিসেম্বর ভোরে তারা শ্রীমঙ্গল থেকে পালিয়ে মৌলভীবাজারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। হানাদাররা পালাবার পথে চা-শ্রমিক নেতা ও চা শিল্পাঞ্চলের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পবন তাঁতিকে হত্যা করে। পাক হানাদার বাহিনী ৬ ডিসেম্বর শ্রীমঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় প্রায় বিনা বাধায় মুক্তিসেনারা শ্রীমঙ্গলকে হানাদারমুক্ত করেন। উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

এর পূর্বে ১৯৭১ সালের ১ মে শ্রীমঙ্গলে ফিনলে টি কো¤পানির ভাড়াউড়া চা বাগান এলাকায় ৪৭ জন চা শ্রমিককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছিল পাক হানাদার বাহিনী। শ্রীমঙ্গল-ভাড়াউড়া চা বাগান সড়কের পাশে কলেজ রোডে নির্মিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিসৌধ আজও সে ঘটনার নীরব সাক্ষী বহন করে চলেছে। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল পৌর শহরের হবিগঞ্জ রোডের ওয়াপদার অফিসের পেছনে একটি ছড়ায়, সিন্দুরখান বিজিবি ক্যাম্পসংলগ্ন মাঠে ও বর্তমান বিজিবি সেক্টরের পাশে সাধু বাবার বটতলাসহ (বর্তমান বধ্যভূমি-৭১) শহর ও শহরতলির বেশ কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল। এসব এলাকার গণহত্যা ছাড়াও পাক হায়েনাদের সঙ্গে দেশ মাতৃকামুক্ত করতে মরণপণ যুদ্ধে শহীদ হন শহীদ সমীর সোম, সাং-জালালিয়া সড়ক, শ্রীমঙ্গল পৌরসভা; শহীদ হাফিজ উল্লাহ, সাং-মৌলভীবাজার রোড, শ্রীমঙ্গল পৌরসভা; শহীদ মুকিত লস্কর, সাং-মিশন রোড, শ্রীমঙ্গল পৌরসভা; শহীদ আবদুল মজিদ (সেনা), সাং-কালিঘাট রোড, শ্রীমঙ্গল পৌরসভা; শহীদ আলী আকবর, গ্রাম-লইয়ারকুল, ভুনবীর ইউনিয়ন; শহীদ আবদুর রহমান, গ্রাম-লইয়ারকুল, ভুনবীর ইউনিয়ন; শহীদ কদর আলী, গ্রাম-লইয়ারকুল, ভুনবীর ইউনিয়ন; শহীদ রহিম উল্লাহ, গ্রাম-লইয়ারকুল, ভুনবীর ইউনিয়ন; শহীদ জৈন উল্লাহ, গ্রাম-লইয়ারকুল, ভুনবীর ইউনিয়ন; শহীদ আলী আজগর, গ্রাম-লইয়ারকুল, ভুনবীর ইউনিয়ন; শহীদ ইসহাক মিয়া, গ্রাম-আলীসারকুল, ভুনবীর ইউনিয়ন; শহীদ রফিক মিয়া, গ্রাম-পাত্রীকুল, ভুনবীর ইউনিয়ন; শহীদ আশুতোষ দেব, গ্রাম-ভাড়াউড়া, শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন; শহীদ আলম মিয়া, গ্রাম-সুইনগড়, শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন; শহীদ আনিছ মিয়া, গ্রাম-বিরাহীমপুর, শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন; শহীদ আবদুল আজিজ, গ্রাম-বিরাহীমপুর, শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন; শহীদ আতাউর রহমান, গ্রাম-শ্রীমঙ্গল বস্তি, শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন; শহীদ রহমত আলী, গ্রাম-শ্রীমঙ্গল বস্তি, শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন; শহীদ নন্দলাল বনিক, গ্রাম-দক্ষিণটুক, সিন্দুরখান ইউনিয়ন; শহীদ মঈন উদ্দিন, গ্রাম-লামুয়া, কালাপুর ইউনিয়ন; শহীদ আলতাফুর রহমান, গ্রাম-লামুয়া, কালাপুর ইউনিয়ন; শহীদ হরমুজ উল্লাহ, গ্রাম-কাকিয়াবাজার, কালাপুর ইউনিয়ন; শহীদ কুনকুনিয়া রুদ্রপাল, কালিঘাট চা বাগান, কালিঘাট ইউনিয়ন; শহীদ আগানা অলমিক, মাকড়িছড়া চা বাগান, সাতগাঁও ইউনিয়ন এবং শহীদ খেট্টা অলমিক, মাকড়িছড়া চা বাগান, সাতগাঁও ইউনিয়ন প্রমুখরা।

রাজনগর : মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মৌলভীবাজার মহকুমায় (বর্তমান জেলা) স্থাপিত পাক হায়েনাদের হেড কোয়ার্টার থেকে রাজনগর উপজেলায় টহল দেয় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে রাজনগর থানায় অস্থায়ী ক্যা¤প করে পাক বাহিনী, হানাদার বাহিনী। এই উপজেলায় পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তি সেনাদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়নি। তবে পাঁচগাঁও, খলাগ্রাম, পঞ্চেশ্বর, মনসুরনগরসহ ১১টি গ্রামে ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুঠপাট চালায় পাক হানাদাররা। খলাগ্রামের ধরের বাড়িতে ১৪ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। আজও সেই স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে ‘ধর বাড়ি’র বহু পুরোনো সেই জীর্ণ ভবনটি। পাঁচগাঁও গ্রামের ৭৬ জন হিন্দু পুরুষকে পুকুরপাড়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এ ছাড়া হিন্দু নারীদের অবাধে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণ করে পাক বাহিনী। একসময় প্রতিরোধ শুরু করে মুক্তিসেনারা। তাদের প্রতিরোধের মুখে ৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী রাজনগর থেকে পালিয়ে যায় এবং শত্রুমুক্ত হয় রাজনগর।

কুলাউড়া : সারা বাংলায় মার্চ মাসেই পাকিস্তানি সামরিক শাসক অত্যাচার নিপীড়ন শুরু করলেও কুলাউড়া থানায় পাক বাহিনী প্রথম প্রবেশ করে ১৯৭১ সালের ৭ মে। মৌলভীবাজার থেকে পাক হানাদার বাহিনী কুলাউড়া প্রবেশের পথে কাপুয়া ব্রিজের কাছে তাদের গতিরোধ করতে অকুতোভয় বীর সৈনিক জয়চন্ডী ইউনিয়নের মো. আকরাম ওরফে আছকির মিয়া ও হাবীব উদ্দিন এগিয়ে যান। এ দুই বীর মুক্তিসেনা ও পাক বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ সময় গুলিবিনিময়ের পর বীর মুক্তিসেনা মো. আকরাম ওরফে আছকির মিয়া ও হাবীব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এরপর কুলাউড়ায় প্রবেশ করে পাক সেনারা তাদের এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় হত্যা, নির্যাতন শুরু করে। ৫ এপ্রিল জয়চন্ডী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকারদের সহায়তায় পাক সেনারা ২২ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে হত্যা করে। ২৪ মে এবং ১৪ জুন দুইদফা মীরবক্সপুর গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এরপরই মুক্তিসেনারা কুলাউড়ায় অপারেশন শুরু করে। দত্তগাঁও, চাতলাপুর চা বাগান, চাতলাপুর আলীনগর ফাঁড়ি, পাইকপাড়া, মনু রেলস্টেশন, পৃথিমপাশা, বরমচাল, জুড়ী, বাজার, জুড়ী চা বাগান, ফুলতলা চা বাগান, মনু রেলস্টেশন লাইন, কর্মধা এলাকায় দফায় দফায় অপারেশন করে মুক্তিসেনারা। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এবং ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ মিত্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে যুদ্ধের গতি তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময়ে সর্ববৃহৎ ও সর্বশেষ অপারেশন হয় গাজীপুর চা বাগানে। ওই চা বাগানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। পাক হানাদারদের ওই ঘাঁটির নেতৃত্বে ছিল মেজর আবদুল ওয়াহিদ মুঘল। প্রচুর অস্ত্র নিয়ে এক ব্যাটালিয়ন পাক সেনা ওই ঘাঁটিতে অবস্থান করছিল। অপরদিকে গাজীপুরের বিপরীতে চোঙ্গা বাড়িতে ছিল মুক্তি বাহিনী ক্যা¤প। মুক্তিসেনারা নভেম্বর মাসের শেষ দিকে গাজীপুর চা বাগান এলাকা মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা মতে, এম এ মোমিত আসুকের নেতৃত্বে মুক্তিসেনারা প্রথম এসে সাগরনাল চা বাগানে অবস্থান নেন। এরপর ভারতের ধর্মনগর থেকে কর্নেল হর দয়াল সিংহের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী ৬৭ রাজাপুর রেজিমেন্টের বিরাট একটি দল সেখানে আসেন। ৩০ নভেম্বও যৌথ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে কাকুরা চা বাগানে অবস্থানকারী ৭৫ জন রাজাকার ও ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য। ১ ডিসেম্বর কাকুরা চা বাগান থেকে মুক্তিসেনারা গাজীপুর চা বাগান এলাকার দিকে রওনা হন। সেখানে ২ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুক্তিসেনাদের যুদ্ধ হয়। ৩ ডিসেম্বর ৪-৫ গোর্খা রেজিমেন্ট কর্নেল হারকিলের নেতৃত্বে একটি দল যৌথ বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসে। পেছনে ৯৯ মাইল্টেল ব্রিগেডের আর্টিলারি সহায়তায় ওই রাতেও পাক সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। মরণপণ যুদ্ধের পরও গাজীপুর চা বাগান এলাকা দখলমুক্ত সম্ভব হয়নি। ফলে ৪ ডিসেম্বর যুদ্ধের পরিকল্পনা বদলে ফেলা হয়। পেছন দিক থেকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেন কর্নেল হারকিল। সে অনুযায়ী এম এ মোমিত আসুক ও মোহন লাল সোম পেছনে আসার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাত ১২টায় সম্মিলিত বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ দিকে লস্করপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল এ যুদ্ধে অংশ নেয়। রাতব্যাপী ওই যুদ্ধে প্রায় ২৫০ জন পাক সেনা প্রাণ হারায়। যারা জীবিত ছিল তারা সবাই পালানোর চেষ্টা করে। ৫ ডিসেম্বর গাজীপুর চা বাগান এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। ওইদিনই সন্ধ্যার দিকে সম্মিলিত বাহিনী কুলাউড়ায় পৌঁছেন। এ রাতেই সব পাকিস্তানি সেনারা ব্রাহ্মণবাজারের দিকে পালিয়ে যায়। এভাবেই ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া শত্রুমুক্ত হয়। কুলাউড়া থানায় উড়ানো হয় লাল-সবুজের পতাকা। কুলাউড়া থানায় বিভিন্ন স্থান থেকে অংশ গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৪৫০ জন শহীদ হন।

বড়লেখা : মহান মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা থানাটি ৪নং সেক্টরের অধীনে ছিল। যার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর সি আর দত্ত। এ সেক্টরের সদর দফতর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের করিমগঞ্জে। এটির নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী। বড়লেখা থানার পার্শ্ববর্তী বারপুঞ্জি ও কুকিরতলে মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়। এ সাব-সেক্টরের মুক্তি সেনারা পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বড়লেখার বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। পাক হানাদার বাহিনী বড়লেখাতে সব সময়ই অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। তবু সেখানে সম্মুখ সমরে বেশ কয়েকজন মুক্তি সেনা শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে অনেকটা নাকাল হয়ে পাক হায়েনারা বড়লেখা থেকে মৌলভীবাজারের দিকে পালিয়ে যায়। তারা পালিয়ে যাওয়ার পর বড়লেখা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। পাক হানাদার বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার পর ওইদিনই বর্তমানে যেখানে বড়লেখা উপজেলা পরিষদ ভবন, সেখানে এক বিজয় সমাবেশ করেন মুক্তি সেনারা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close