গোপাল অধিকারী

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৯

প্রত্যাশা

ট্রেন দুর্ঘটনা কাম্য নয়

ট্রেনভ্রমণ। একটি নিরাপদ ও আনন্দদায়ক ভ্রমণের নাম। ট্রেনভ্রমণ নিরাপদ ও আরামদায়ক কথাটার সফঙ্গ আমার বিশ্বাস অনেকে একমত হবেন। কারণ বাংলাদেশে সড়কপথে দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ট্রেনভ্রমণে সড়কপথের মতো নেই ভোগান্তি, নেই যানজটের ঘনঘটা, নেই দুর্ঘটনার ফুলঝুরি। যে কারণে ট্রেনভ্রমণে যাত্রীর মহামারি। ট্রেনভ্রমণের কথাটা মনে হলেই যেন মন আনন্দে নেচে ওঠে। মনে হয় পাঠ্যপুস্তকে পড়া ট্রেনভ্রমণ ও নৌকাভ্রমণ রচনার কথা। পাঠের বাইরে মনে এক উৎফুল্লতা ও একটি আনন্দদায়ক ও মনোরঞ্জনের বিষয় ছিল জার্নি বাই ট্রেন। যদিও বাস্তবে ট্রেনভ্রমণ কিছু বেদনাদায়কও ছিল। কারণ ট্রেনভ্রমণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যের বাইরে গ্রাম, শহর যেমন দেখা যায়; তেমনি দেখা যায় দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত ছিন্নমূল মানুষের জীবনযাপন। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেনভ্রমণে মানুষের চাহিদা বেশি বলে আমার মনে হয়েছে। কারণ স্ট্রেশনে টিকিট কাটতে শোনা যায় সিট নেই। এখন ট্রেনে কোথাও যেতে হলে আগে থেকেই টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। ট্রেন যেহেতু সরকারি সম্পত্তি। একজন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমি ট্রেনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে সাধুবাদ জানায় ও রেল মন্ত্রণালয়ের উন্নতি কামনা করি। সেই সফঙ্গ বলতে চাই, ট্রেন দুর্ঘটনা কারো কাম্য নয়। কেন ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটবে বলতে পারেন? ট্রেনপথে কি সড়ক পথের মতো যানজট বা জনসমাগম আছে? ট্রেন কি মিনিটের পর মিনিটে আসে? কিন্তু তার পরও দুঃখের বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেনের কয়েকটি নেতিবাচক ঘটনা ট্রেনের সুনামকে ভূলুণ্ঠিত করে তুলছে।

সামান্য ভুলে কখনো কখনো ট্রেনেও বড় দুর্ঘটনা ঘটে। একজন চালকের সামান্য ভুলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি বিশাল এ প্রতিষ্ঠান। এর বেশির ভাগ হয় লাইনচ্যুত হয়ে বা মুখোমুখি সংঘর্ষে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে সব মিলিয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১টি। ইতিহাস বলে ট্রেনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা : ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টঙ্গীর কাছে মাজুখানে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭০ জন যাত্রী নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় আরো ৪০০ জন। ১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীর কাছে একটা রেলসেতু দিয়ে চলার সময় ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে পরপর কয়েকটা স্পান ভেঙে পড়ে। কয়েকটি বগি নিচে শুকনা জায়গায় পড়ে। এ দুর্ঘটনায় ৬০ জন যাত্রী নিহত হয়। ১৯৮৫ সালের ১৩ জানুয়ারি খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের কোচে আগুন ধরে যায়। এতে ২৭ জন যাত্রী নিহত হয় এবং ২৭ জন আহত হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ সর্বহারার নাশকতায় ভেড়ামারার কাছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয় এবং নদীতে পড়ে যায়। এতে ২৫ জন যাত্রী নিহত হয় এবং ৪৫ জন আহত হয়। ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি রাত সোয়া ৯টায় গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী ৫১১ নম্বর লোকাল ট্রেনটি হিলি রেলস্টেশনের ১ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ায়। এর কিছুক্ষণ পর সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী ৭৪৮ নম্বর আন্তঃনগর সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই লাইনে ঢুকে পড়ে। এ সময় ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষে গোয়ালন্দ লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিনসহ দুটি বগি আন্তঃনগর ট্রেনের ওপর ওঠে যায়। এতে দুটি ট্রেনের অর্ধশতাধিক যাত্রী নিহত হয়। আহত হয় দুই শতাধিক। কমিউটার ট্রেনটি জামালপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিল। টঙ্গী এসেই ঘটে যত বিপত্তি। ট্রেনের ৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। টঙ্গীর নতুনবাজার এলাকায় দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা-জয়দেবপুর রেললাইনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয় অর্ধশতাধিক। সেদিন রাত ১২টার দিকে কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশনের পাশে ঢাকাগামী উপবনের বগি ছিটকে পড়ে। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭ জন নিহত হয়। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ভোররাত পৌনে ৩টার দিকে উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শতাধিক যাত্রী আহত হয়। সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস এক নম্বর লাইনে ঢুকছিল। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথাকে আউটারে থাকার সিগন্যাল দেওয়া হয়। চালক সিগন্যাল অমান্য করে মূল লাইনে ঢুকে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ছোট্ট শিশু সোহার লাশ দেখে কাঁদছে সবাই। আহত ছোট্ট শিশু নাঈমা তার মা-বাবাকে হারিয়ে কাঁদছে। কী বেদনাদায়ক দৃশ্য।

এ ছাড়াও পাবনা এক্সপ্রেস ট্রেনচালক ছাড়া রাজশাহী পৌঁছানোসহ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা তো রয়েছে। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি স্থানে সিগন্যাল জটিলতার কারণে একই লাইনে দুটি ট্রেন অবস্থান করেছে; যা দুঃখজনক। যা হতাশাজনক। সড়কে দুর্ঘটনার ঘনঘটায় ট্রেনভ্রমণকে নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে সরকারকে আরো কঠোর এবং সাবধান হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবারও ট্রেন দুর্ঘটনা কারো কাম্য নয়। জানামতে, সব দুর্ঘটনার তদন্ত টিম গঠন করে কারণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে বা নিচ্ছে। তার পরও কেন দুর্ঘটনা থামছে না। জানি দুর্ঘটনা আকস্মিক। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। তার পরও বাংলাদেশ যেখানে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পেয়ে দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করছে; সেখানে ট্রেনে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা কি খুব কঠিন ব্যাপার! মনে হয় না। হয়তো কোনো দিকে কমতি বা ঘাটতি আছে। হয়তো তদন্তে ঘাটতি রয়েছে। আর সে কারণেই বাকিরা প্রশ্রয় পাচ্ছে। হয়তো সাসপেন্ড করার পর আলো-ছায়ার খেলার মতো দোষী ব্যক্তি আবার স্বপদে বহাল হয়েছেন। আর সর্ষের ভূ সর্ষেতেই রয়ে গেছে। দুর্ঘটনার কারণ পর্যালোচনা করে আইন সংশোধন বা সংযোজন করা দরকার। একজন ব্যক্তির ভুল বা অসচেতনতা যে হাজারো মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে, তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের ওপর এমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ কতটা যুক্তিযুক্ত? বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত ও কঠোর ব্যবস্থা নিলে ট্রেন দুর্ঘটনার বর্তমান চিত্র পাল্টে যাবে। তথ্যমতে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ২৩১টি স্টেশনের ৯২টি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে আর ৫৮টি ক্ষয়িষ্ণু। তবে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন প্রায় ৫০টি। এরমধ্যে ১০টি স্টেশন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার আওতায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। বাকি ৪০টি স্টেশন প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিকের আওতায়; যা অনভিপ্রেত। সরকারের উচিত রেলব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করা। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থার অচলাবস্থা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ট্রেনভ্রমণ নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে- এটাই আজ সময়ের দাবি হিসেবে সর্বত্রই প্রতিদ্বন্দ্বিত হচ্ছে। নিরাপদ হোক ট্রেনভ্রমণ- সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের এটুকুই প্রত্যাশা।

লেখক : মানবাধিকারকর্মী ও কলামিস্ট

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close