রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

ব্রিটেন নির্বাচনের ফলাফল কোনদিকে

নানা সমীকরণের পর অবশেষে ব্রিটেনের দুই-তৃতীয়াংশের অধিক এমপি আগাম নির্বাচন দিতে সম্মত হয়েছেন। আগামী ১২ ডিসেম্বর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মরণপণ প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জন বরিসন বলেন, ব্রেক্সিট এবং দেশের উন্নয়নের জন্য জনগণকে মুখ খুলতে হবে। বেক্সিট চুক্তি ও পার্লামেন্টের অচলাবস্থা নিরসনে এই নির্বাচন ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি ব্রেক্সিট কার্যকরের পূর্বনির্ধারিত সময় ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ মাস বাড়িয়ে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় পেয়েছে যুক্তরাজ্য। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে ব্রিটেন এবং ইইউ এই চুক্তিতে একমত হয়। তবে তা কার্যকর করতে হলে ব্রিটিশ এমপিদেরও একমত হয়ে বিলটি পার্লামেন্টে পাস করতে হবে। প্রথমবার ১৫ জানুয়ারিতে ভোট হয়, এতে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ২৩০ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। ১২ মার্চ এমপিরা আবারও এই চুক্তির বিপক্ষে ভোট দেন। এবারের ব্যবধান হয় বিলের বিপক্ষে ৩৯১ এবং পক্ষে ২৪২ ভোট। ২৩ মে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচন হয়। ইইউ হুশিয়ার করে দেয়, ব্রিটেন এই নির্বাচনে অংশ না নিলে এরপর আর সময় বাড়ানো হবে না। এদিকে বিলটি নিয়ে ব্রিটেনের সরকার ও জনগণ বিভক্ত। বেশির ভাগ জনগণ এ বিলের বিরুদ্ধে। তাদের অনেকের দাবি হলো, বিলটি ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইইউয়ের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার মতো সুযোগ দেয়নি। এর চাইতেও বড় আপত্তি হলো, আইরিশ সীমান্তের সীমানা নিয়ে। এদিকে সরকারের ধারণা হলো, এর ফলে কিছু খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে পারে এবং কাস্টমসের চেকিংয়ের জন্য হাজার হাজার পাউন্ড খরচ হতে পারে।

ব্রেক্সিট ইস্যুতে বিতর্ক যেন শেষ হতেই চায় না। ব্রেক্সিট ইস্যুতে থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে বিদায় নিলেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন। তিনি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেন। অবশেষে ব্রেক্সিট ইস্যুতে টানা কমাস টানাপড়েনের পর পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। পার্লামেন্টে আগাম নির্বাচনের পক্ষে ভোট পড়েছে ৮৩৮ এবং বিপক্ষে ২০ জন। এই ভোটের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন। ইউরোপের ২৮টি দেশ নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যার সংক্ষেপ হলো ইইউ। এই জোটের সদস্য দেশগুলোর সুবিধা হলো তারা নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে এবং এক দেশের নাগরিক জোটভুক্ত যেকোনো দেশে গিয়ে থাকতে ও কাজ করতে পারেন। এই জোটের পূর্বনাম ছিল ‘ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কম্যুনিটি’, যার সংক্ষেপ-‘ইইসি’। পরে তা কম্যুনিটির জায়গায় ‘ইউনিয়ন যুক্ত হয়। এই ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেন থাকবে কি না, তা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছিল। মার্গারেট থেচারের প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে এই বিতর্কে। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন গণভোট হয়। এতে ৫২ শতাংশ ভোট পড়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে, আর ৪৮ শতাংশ ভোট ছাড়ার বিপক্ষে। এর পরও বিতর্ক থামে না। ছাড়ার ক্রিয়া-পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। চলতে থাকে আলোচনা এবং সমালোচনা। একদল বলছেন ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে হবে ‘প্রত্যাহার চুক্তি’ করে। চুক্তির বিষয়, ব্রিটেন ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার দেবে। ব্রিটেনের যেসব নাগরিক ইইউভুক্ত দেশগুলোতে তাদের এবং ব্রিটেনে ইইউভুক্ত দেশগুলোর যেসব নাগরিক রয়েছেন- তাদের কী হবে? সে বিষয়ে নীতিনির্ধারণ।

অপরদিকে নর্দান আয়ারল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড রিপাবলিকের মধ্যে ইইউ এবং ব্রিটেনের সীমানা কীভাবে নির্ধারণ হবে, ব্রিটেন এবং ইইউকে একটি নির্দিষ্ট ‘অন্তর্বর্তীকালীন সময়’ দেওয়া যেন তারা একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে এবং নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য বুঝে নিতে পারে, দুপক্ষের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হতে পারে; সে বিষয়ে একটি রাজনৈতিক ঘোষণা ইত্যাদি উল্লেখ ছিল এই চুক্তিতে। ব্রিটেনের নিয়ম হলো, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সাধারণ নির্বাচন হওয়া। কিন্তু গত পাঁচ বছরের কম সময়ে এটি তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে ২০১৭ সালে। সরকার বনাম পার্লামেন্টের বিরোধের মুখে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ কার্যকর করা যায়নি। সর্বশেষ ৩১ অক্টোবর এ বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা পিছিয়ে নতুন তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি। ব্রেক্সিট নিয়ে এমন অচলাবস্থার অবসানে অবশেষে আগাম সাধারণ নির্বাচনের পথ বেছে নিতে হয়েছে। আগাম নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব এনেছিলেন; সেটি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় বাতিল হয়ে গেছে। এর আগে সংসদ সদস্যরা ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে চুক্তি ছাড়া বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আটকে দিয়ে একটি বিল পাস করেছে পার্লামেন্ট। এ বিল যদিও এনেছে বিরোধী দলগুলো, তবে তাদের সঙ্গে রয়েছেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির একদল বিদ্রোহী এমপিও। এই বিলে কনজারভেটিভ পার্টির যে এমপিরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন, তাদের বিদ্রোহী চিহ্নিত করে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

তবে নির্বাচন কেন্দ্র করে তাদের আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচন উপলক্ষে ইতোমধ্যে প্রচারণা শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আশা করছেন, ব্রেক্সিট চুক্তি এবং বর্তমান পার্লামেন্টে অচলাবস্থা নিরসনে তাকে ব্রিটিশ জনগণ নতুন করে ম্যান্ডেট এনে দেবে এ নির্বাচনে। লেবার নেতা জেরেমি করবিন বলেন, ‘দেশ সংস্কার এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এই নির্বাচন বর্তমান প্রজন্মের কাছে একটি সুযোগ। তার দল এখন দেশের সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য সবচে গঠনমূলক আর জোরালো প্রচারণা শুরু করবে, যা এই দেশ এর আগে কখনো দেখেনি। গত ২১ নভেম্বর প্রকাশিত লেবার দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এসব কথা জেরেমি করবিন বলেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ব্রিটেনকে সরকারি খাতের বেতন বৃদ্ধি, সংস্থাগুলোর ওপর উচ্চতর কর এবং অবকাঠামোগত জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্রিটেনে মৌলিক পরিবর্তন করবেন। ব্রিটেনের মধ্যশহর বার্মিংহামে এক বক্তব্যে করবিন তার পরিকল্পনার কথা বলে জনসমাগমকে আনন্দিত করেন এবং পরিকল্পনাটি তিনি তৈরি করেছেন ব্রিটেনের প্রত্যেকের জন্য কিছু উপহার হিসেবে, তা উল্লেখ করেন। তিনি তার পরিকল্পনায় আরো বলেন, ছোটদের বাবা-মায়েদের বিনামূল্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করার জন্য এবং বয়স্কদের যত্নের জন্য আরো অর্থ ব্যয় করা হবে। সমর্থকদের মধ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, তারা সরকার গঠন করলে ওই ‘ব্যাংকার, বিলিয়নেয়ার্স এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়াবেন ‘যারা তাদের অনুকূলে দন্ডিত ব্যবস্থা রাখতে লড়াই করে যাচ্ছিল।

কিন্তু লেবারের ইশতেহারকে অনেকেই মনে করেন, ব্রিটেনের জনগণের প্রত্যাশার প্রতীক এবং তা এমন একটি ইশতেহার যা ব্রিটেনে সত্যিকারের পরিবর্তন আনবে। জেরেমি করবিন নিজেও মনে করেন, এই দশকের মধ্যে তার ইশতেহারে রয়েছে বৈপ্লবিক এবং প্রেরণাদায়ক পরিকল্পনা। এই জনপ্রিয় ইশতেহার একটি প্রজন্মের জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অবরুদ্ধ করে দিয়েছে। ইশতেহারে অতিরিক্ত ৮২.৯ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় দেখানো হয়েছে, যা ৮২.৯ বিলিয়ন পাউন্ডের রাজস্ব-উৎসের ব্যবস্থার সঙ্হে মিলেছে। উভয়পক্ষই নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক কৃপণতা বন্ধ করার এবং জনসাধারণের পরিষেবাগুলোতে আরো বেশি অর্থ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের প্রস্থান কখন এবং কীভাবে হবে, তা নির্ধারণ করবে। জেরেমি করবিনকে যারা জানেন, তারা স্বীকার করবেন, তিনি মিডিয়ার সামনে অভিনয় জানেন না, অভিনয় করেন না। তিনি মিডিয়ার সামনে চটকদার কথা বলে কিংবা অভিনয় করে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টাও করেন না। তিনি তা-ই বলেন, যা বিশ্বাস করেন। তিনি একেবারে সাধারণ মানুষের মতো একেবারে সাধাসিধে। অনেকেই মনে করেন, আগামী ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জেরেমি জিতে যেতে পারেন। আমরাও চাই, তিনি জিতে গিয়ে সরকার গঠন করুন। আসলে পৃথিবীতে কিছু মানুষ এমন আছেন, যাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধা হয়ে যায়। এমনি একজন ব্যক্তিত্ব হলেন ব্রিটেনের বর্তমান লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিন। তার প্রতি আমাদের প্রেম-ভালোবাসা রয়েছে। ২০১৭-এর নির্বাচনেও আমাদের প্রত্যাশা ছিল তিনি বিজয়ী হবেন। কেন এই শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা? কারণ; তিনি সাধারণ মানুষকে ভালোবাসেন।

আমাদের যতটুকু জানা, তিনি আজীবন সাধারণ মানুষের মুক্তির স্বার্থে কথা বলেছেন, সংগ্রাম করেছেন। তিনি প্রতিবাদ করেছেন ধনী-তোষণের রাজনৈতিক নীতিসমূহের। বিশে^র যেখানেই মানুষ নির্যাতিত; সেখানেই তিনি প্রতিবাদমুখর হয়ে ময়দানে এসেছেন। বিভিন্ন দেশের মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধেও তিনি প্রকাশ্য মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। ফিলিস্তিনের পক্ষে গলায় ফিলিস্তিনি কালো রোমাল বেঁধে রাজপথে মিছিলে অংশ নিয়েছেন। ফলে শুধু তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, নিজের দল লেবারেরও পুঁজিবাদী আর যুদ্ধবাজরা বাঁকাদৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকেন। অনেকে তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বা গোপনে কাজ করেছেন কিংবা করছেন। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া যুদ্ধে পশ্চিমাদের ভূমিকার তিনি স্পষ্ট বিরোধী। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে নিজ দেশে বন্ধ করবেন পরমাণু অস্ত্র উৎপাদন। করহার বাড়াবেন বড় করপোরেট ও ধনীদের। তার প্রতিশ্রুতির মধ্যে আরো রয়েছে নি¤œতম মজুরি ১০ পাউন্ড নির্ধারণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রেল যোগাযোগ রাষ্ট্রায়ত্ত করা, চিকিৎসা খাতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি; অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি জোরদার করা। সর্বোপরি তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি কাজ করবেন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য, গুটিকয়েক ধনী ব্যক্তির জন্য নয়। ডিসেম্বর মাস ব্রিটেনে ক্রিসমাস, বকসিন ডে এবং ১ জানুয়ারি নিউ ইয়ার ডে ইত্যাদি অনুষ্ঠানাদির কারণে সেখানে আয়োজন থাকে অন্যরকম। সাধারণত এই মাসে নির্বাচন হওয়ার নিয়ম নেই। তাই ব্রিটেনের জেরেমি করবিন দেখা যায় ডিসেম্বর মাসে মাত্র দুটি নির্বাচন হয়েছে। প্রথমটি হয়েছিল ১৯২৩ সালে। আর দ্বিতীয়টি হবে ১২ ডিসেম্বর ২০১৯। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close