মেরিনা জাহান

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

আলোচনা

খুদে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান কৌতূহল

আমরা যখন বিজ্ঞানের কথা বলি, তখন আসলে এসব ‘কেন’- এর উত্তর সহজভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার কথাই বলি। এটা বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা। তিনি বলেছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে শেখা, প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা যাবে না। এই প্রশ্ন করাটাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরাই প্রশ্ন করে, তাদের কৌতূহল রয়েছে, তাকে থামানো যাবে না, এমন প্রশ্ন করতেন টমাস আল্ভা এডিসন তার ছেলেবেলায়। শিক্ষকরা তার ওপর অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেন। প্রশ্ন করতেন রাইট ব্রাদারস, উইল্ভার রাইট ও অরবিল রাইট। মাছ মারতে গিয়ে দেখেন, পাখি ছো মেরে মাছ নিয়ে যায়। প্রশ্ন জেগেছে তাদের মনে, পাখি কীভাবে উড়ে। এই জিজ্ঞাসা থেকেই পরবর্তীতে তারা আবিষ্কার করেন উড়োজাহাজ।

আমাদের শিশুদের প্রশ্ন করার অভ্যাসকে দমিয়ে দেওয়া যাবে না, বরং তাদের মনে এই গভীর জিজ্ঞাসার জন্ম দিতে হবে। কৌতূহলের জবাব তৈরি করার জন্য সহযোগিতা করতে হবে। আর এই জিজ্ঞাসার সূত্রপাত হোক শিশু বয়স থেকেই। একজন শিক্ষক হিসেবে শিশুদের কৌতূহলকে দমন করা নয়, তাদের মধ্যে জিজ্ঞাসার বীজ বুনতে চাই। যাতে সুস্থ বিজ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে তারা জিজ্ঞাসার জবাব জানতে পারে। যাতে বিজ্ঞানমনস্ক সুস্থ সামাজিক বলয় গড়ে ওঠে। অগ্রসরমান পৃথিবীতে জাতি হিসেবে আমাদেরও স্বাক্ষর রাখা চাই। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন আরেকটি কথা বলেছেন, ‘চলতি জ্ঞানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চিন্তা ও কল্পনা করতে পারা।’ এর অর্থ হলো প্রশ্ন করে প্রকৃতির সব ঘটনার যুক্তিসংগত কারণ জানতে পারলে আমরা বিজ্ঞান সচেতনতা অর্জন করব। আমরা সহজে কুসংস্কার মুক্ত থাকতে পারব, মুক্তচিন্তার বিকাশ হবে। দূর হবে সংকীর্ণতা। বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগী, অনুসন্ধিৎসু হয়ে বেড়ে উঠবে আমাদের প্রজন্ম।

এই চিন্তার জায়গা থেকেই কিছুদিন আগে বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার ভান্ডার পাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো সপ্তাহব্যাপী বিজ্ঞানমেলা। শিশুদের সৃজনশীল বিকাশে, তাদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই বিজ্ঞান মেলার আয়োজন। শিশু মনে বিজ্ঞান চিন্তার বীজ বপন করে আর যতœশীল করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই মেলা।

মানবসভ্যতা এগিয়েছে সেই ঊষালগ্ন থেকে, হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিভিন্ন সময়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরেই। অগ্রসর মানবজাতি ও দেশের কাতারে দাঁড়াতে আমাদেরও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদান রাখতে হবে।

গোটা বিশ্বের নানা প্রান্তে চলছে তার ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তুতি। এ ক্ষেত্রে জাতির নির্ভরতার জায়গা হলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আমরা চাই আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠুক শুভশক্তির বলয়ের মাঝে সব নেতিবাচকতাকে পিছে ফেলে এগিয়ে যাক সামনের কাতারে। বিজ্ঞানমনস্ক ও সৃজনশীল প্রজন্ম হিসেবে তারা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠুক সুস্থ বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে।

শুধু রাজধানী নয়, প্রত্যন্ত এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে নানা মরণঘাতী নেশা। শিশু অনেক আত্মঘাতী গেম ‘ব্লু হোয়েল’ ‘পাবজি’ আরো অনেক কিছুতে আসক্ত হয়ে পড়ছে; যা নিষ্পাপ প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। নেশাসক্ত ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দিকে লিপ্ত হওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে আমাদের প্রিয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তাছাড়াও যুদ্ধ, ধ্বংস, অস্বাভাবিক গতিনির্ভর গেমস- এগুলো তাদের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ফলে তাদের মধ্যে আগ্রাসী, ধ্বংসাত্মক এবং ঝুঁকিপ্রবণ আচরণের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। মোবাইল গেমস আসক্তির কারণে শিশুর স্বাস্থ্যের ওপরও নানা ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। চোখের ক্ষতি, মাথাব্যথা, নিদ্রাহীনতা, ধীরে ধীরে তারা অসামাজিক হয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের প্রিয় সন্তানরা।

বিজ্ঞান মেলার প্রস্তুতি নেওয়ার আগে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের কিছু পরীক্ষা দেখানো হয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তবু অনেক কিছু বুঝতে পারে ১ম-৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তো আরো ছোট। তাদেরও পরীক্ষা করে দেখাতে হয়েছে তাদের আগ্রহকে বাড়িয়ে তোলার লক্ষ্যে। দেখাতে হয়েছে, কী করে ভরা পানির গ্লাসে কাগজ দিয়ে ঢেকে দিয়ে উল্টালে বাতাসের ঊর্ধ্বচাপের কারণে সেই পানি পড়ে যায় না। কী করে অক্সিজেন আগুন জ্বলতে সাহায্য করে, বাতাসেরও ওজন আছে, উদ্ভিদ যে পানি শোষণ করে- এ রকম আরো অনেক তথ্য। শিক্ষার্থীরা তখন হাততালি দিয়ে বলেছিল জাদু। শিক্ষক বলেছিলেন, জাদু নয় বিজ্ঞান। ‘গ্লাসের পানি পড়ছে না কেন? এটা বাতাসের ঊর্ধ্বচাপের কারণে, বাতাস তোমাকেও চারদিক থেকে চাপ দেয়। পানি রাখা থালায় উল্টো করা গ্লাসের ভেতর জ্বলে থাকা মোমবাতি নিভে গেল কেন? অক্সিজেন যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ জ্বলছিল আর অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলেই আগুন নিভে গেল। গ্লাসের যতটুকু অংশজুড়ে অক্সিজেন ছিল, ততটুকু অংশেই পানি ওপরে উঠে গেছে। বেলুনে বাতাসের ওজন আছে, তাই বেলুন ওপরে উঠে গেল। প্যাপারমিয়া উদ্ভিদটি লাল হলো কেন? উদ্ভিদটি লাল পানিতে ছিল, পানি শোষণ করেছে বলেই গাছটি লাল হয়েছে।’

বিজ্ঞান মেলাতে যখন একটি আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল; তখন সহকারী শিক্ষা অফিসার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রত্যেকটি প্রজেক্ট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন এবং মনোযোগসহকারে শুনেন। শিক্ষার্থীদের একটি বিজ্ঞান সম্পর্কিত ম্যাজিক শো শিখিয়ে দেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কিছু সময় অতিবাহিত করেন; যা শিক্ষার্থীদের আরো উৎসাহিত করে তোলে। তিনি মন্তব্য করেন, প্রতি বিদ্যালয়ে একটি করে বিজ্ঞানাগার থাকা উচিত এবং এ ধরনের মেলা প্রতি বছর উদযাপন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

লেখক : প্রধান শিক্ষক

ভান্ডার পাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

শাহজাহানপুর, বগুড়া

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close