মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

সভ্যতার পাদপিঠে পণ্য হিসেবে নারী

সম্প্রতি পণ্যসভ্যতার বিকট থাবা থেকে মুক্তি নেই নারীর। বিক্রি হতে হবে প্রসাধনসামগ্রী। সাবান, শ্যাম্পু, লোমনাশক ক্রিম। সেসব বিক্রি করতে নারীকেও পণ্য করে তোলা হচ্ছে দুনিয়াব্যাপী। নির্ধারিত মাপ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের জন্য। নির্দিষ্ট ছাঁচে পড়লেই তুমি সুন্দরী। বিশ্বসুন্দরী। বোকাবুদ্ধু মেয়েরাও ছুটে ‘সেই ফিগার’ গড়ে তুলতে। ‘জিরো

ফিগার’ চাই, যে করেই হোক, মাপে আনতে হবে দেহটাকে। প্রয়োজনে ডায়েটিং করে, না খেয়ে থেকে। ইউরোপেও

যে কত মেয়ে না খেয়ে ‘এনিমিয়া’, ‘বুলিমিয়ার’ মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। পশ্চিমে কয়েক বছরে

বেশ কজন মডেল ওভার ডায়েটিংয়ে মারাও গেছেন। মেয়েরা ছুটছেন পারলারে, জিমে। পারলার থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েগুলোকে দেখতে মনে হবে, সবাই একই ছাঁচে গড়া; সুন্দরী প্রতিযোগিতার ‘গ্রুমিং সেশনের’ মেয়েদের মতো। গ্রুমিং শেষে সবাই একই রকমভাবে হাঁটে, বসে, কথা বলে। মনে হয় ‘পাপেট’-এর দল।

মিডিয়া সুন্দরী প্রতিযোগিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও প্রচারে বিভোর সবসময়ই। মিডিয়া ভীষণ নারীবান্ধব, মানবিক, সবসময় এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বাণিজ্যিক মিডিয়ার প্রভু পুঁজি। ফলে সে যাকে বিকোতে পারে, যা বিকোনো যায়, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে স্বাভাবিক। পণ্য হিসেবে নারীর চেয়ে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা আর কোন পণ্যের নিশ্চয়তা আছে? ফলে বাণিজ্যিক মিডিয়া মেধাবী, প্রতিভাবান মেয়েদের চেয়ে অমেধাবী, অপ্রতিভাবানদেরই খোঁজে বেশি। ফলে কেবল খোলামেলা হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে অনেকে তারকা হন। মিডিয়ায় ‘সাহসী মেয়ে’ বলে একটি টার্ম চালু রয়েছে। প্রায়ই দেখা যায়, শরীরসর্বস্ব, গা খোলা মেয়েদের সাহসী বলে সমর্থন জোগাতে। দাঁত উঁচু, লিকলিকে, এমন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করলেও তার চেয়ে মেধাশূন্য গা খোলা, ভরাট শরীরের মেয়েদেরই মিডিয়া প্রচার করে, দুদিনেই তারকা বানাতে অস্থির হয়ে ওঠে। আর এই মেয়েরাও খোলামেলা হয়ে ছবি তুলে নিজেকে ‘তথাকথিত তারকা’ ভেবে মিথ্যে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে।

পর্নো তারকাদেরও যেমন ‘তারকা’ বলে ধারণা দেওয়া হয়, নেহাৎ বাণিজ্যিক কারণে, তারাও তেমন কে কত বেশি যৌন হেনস্তা, যৌন নির্যাতিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে, সে নিরিখে ‘বড় তারকা’খ্যাতি পায়। একটিবারের জন্যও সে ভাবে না, মানুষের মূল্য আসলে কিসে? সে যে একটি যৌনবস্তু হয়ে উঠছে, ভোগ্যবস্তু বনে যাচ্ছে, তাতে তার কোনো ভাবাবেগ নেই। প্রতিটি সুন্দরী প্রতিযোগিতা, আয়োজন, আয়োজক কোনো না কোনো নারী বাণিজ্যের নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। পণ্য হতে আসা, পতিতা হতে আসা মেয়েদের কিছু পুরুষতন্ত্র চিরকালই বুঝিয়েছে- ‘এটা তোমার স্বাধীনতা, এটা নারী স্বাধীনতা, তুমি অনেক বেশি স্বাধীন, তুমি চাইলেই খুলতে পারো, ছুঁতে পারো, শুতে পারো যে কারোর সঙ্গে।’ স্বাধীনতা ও নারীবাদের অসম্ভব ভুল ব্যাখ্যা এসব মেয়ের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে নেহাত বাণিজ্যিক স্বার্থে। অথচ নারীবাদ, মানবতাবাদ ও নৈতিকতাবাদ সেটাই, যেটা নারীকে পুরুষতন্ত্রের বাণিজ্যিক চাহিদার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলতে শেখাবে- ‘আমি নারী। আমি সম্পূর্ণ মানুষ। চাইলেই আমি খুলতে পারি না। যাকে তাকে ছুঁতে কিংবা যার তার সঙ্গে শুতে পারি না।’ দানবীয় পুঁজির হাতে বন্দি আজ মানুষ, মানবিকতা, যৌনতা। তাই প্রাচীন যৌনদাসীর বদলে আধুনিক চকচকে করপোরেট যৌনদাসীই বানাতে চায় করপোরেট পুঁজি। নাম দেয় বিউটি হান্ট, ফান্টসহ নানা কিছু। আসল রহস্য হলো, ভেতরে বাণিজ্য, বাইরে সৌন্দর্য। যৌন বাণিজ্যই যদি শেষাবধি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য না হবে, তবে ‘ভার্জিনিটি’ইবা খোঁজা কেন? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অসহায়, নির্বুদ্ধিমান মেয়েরা পুঁজি আর পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পড়ে এসব তথাকথিত প্রতিযোগিতার মঞ্চে এসে দাঁড়ায়।

‘মেয়ে! তোমার সাইজ কত?’ ফেসবুকে কেউ যদি এমন স্ট্যাটাস দেয়, তাহলে ফ্রেন্ডলিস্টের ভদ্র, অভদ্র সব পুরুষই যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে আক্রমণ শুরু করবেন। ভদ্র মহিলারা সমস্বরে জানতে চাইবেন- ‘ঘরে মা-বোন নেই?’ রাস্তাঘাটে কোনো তরুণীর সাইজ জানতে চাইলে, তার বাবা, ভাই, চাচা, মামা, খালু, আত্মীয়-অনাত্মীয়, প্রতিবেশী পিঠের চামড়া তুলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হবেন। কোনো এক জ্ঞানী বলেছেন, ‘বাজারে যদি মাগনা দুধ পাওয়া যায়, তাহলে কষ্ট করে গাই পোষে কে?’ কেউ যদি ফ্রিতেই সাইজ জানায়, তাহলে এত রিস্ক নিতে যাবে কোন স্টুপিডে! সাম্প্রতিক ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগীদের নিয়ে মিডিয়ার মাতামাতি দেখে ডিমপাড়া মুরগির কথা মনে পড়ছে। হাতি ১০০ কেজি ওজনের বাচ্চা জন্ম দিয়েও চুপ থাকে। আর মুরগি ১০০ গ্রাম ওজনের ডিম পেড়েই চিৎকার শুরু করে দেয়। প্রায় পঁচিশ হাজার তরুণি এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এদের মাঝে মাত্র একজন ‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। বাকি ২৪ হাজার ৯৯৯ প্রতিযোগীর ভাগ্যে কী ঘটে, সেটা আমাদের জানা নেই। তবে এরা কীভাবে ‘ইয়েস কার্ড’ পেয়েছে, সে সম্পর্কে একটুখানি ধারণা দিই।

এদের প্রত্যেকের উচ্চতা, ওজন, কোমর, নিতম্ব, স্তনসহ শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গের সাইজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েই আবেদন করতে হয়। মিডিয়া খুব সহজে সুন্দর বিষয়কে অসুন্দর আর অসুন্দর বিষয়কে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারদর্শী। এভারেস্ট বিজয়ের গল্প মিডিয়া খুব ফলাও করে প্রচার করে। কিন্তু এভারেস্টে চড়তে গিয়ে কজন প্রাণ হারায়, সে হিসেব ওরা চেপে রাখে। এই ২৪ হাজার ৯৯৯ মেয়ে অন্যদের স্পর্শে নিজেদের ‘ভার্জিনিটি’ হারাল, মিডিয়া সেটা চেপে রেখে বিজয়ী একজনকে নিয়েই মেতে ওঠে। আর সেটা দেখে আগামীতে দ্বিগুণ প্রতিযোগী অংশ নেয়। এসব প্রতিযোগীর অভিভাবকরাই হেসে হেসে বিচারকদের হাতে এদের দৈহিক বিবরণ তুলে দেয়। এদের বাবা, ভাই, চাচা, মামা, খালু, আত্মীয়-অনাত্মীয়, প্রতিবেশী ভদ্রলোকেরা সে প্রতিযোগিতা দারুণভাবে উপভোগ করে। গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে অনেক গাভী ছাড়াবস্থায় দেখা যায়।

নিজেদের হেডম দেখানোর জন্যই অনেক গৃহস্থ এদের ছেড়ে রাখে। তাদের প্রভাবে কেউ কিছু বলতে পারে না। সামনে কেউ কিছু না বললেও গোপনে এসব ছাড়া গাই থেকে দুধ

দোহন করে অনেকেই বিনামূল্যে নিজেদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে। গৃহস্থ বৈ গাই-গরুর শরীরে সাধারণত অন্য কেউ হাত বোলাতে গেলে সে পা দিয়ে লাথি মারে। কিন্তু এসব ছাড়া গাভীর শরীরে অনেকের হাত লাগতে লাগতে সে নিজেই ভুলে যায় তার আসল গৃহস্থ কে!

সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে নারীকে জড়িয়ে যেসব অশ্লীল আয়োজনের জোয়ারে ভাসছে পৃথিবী, তা নিয়ে দুনিয়ার সব সুশীলজন বড়ই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। এটা কেমন প্রতিযোগিতা, যার বিভিন্ন ইভেন্টে শরীরের মাপ দিতে হয়। তাও সে মাপ আবার পুরুষদের নির্ধারিত মাপের ছকেই। স্তনকে বাধ্য করতে হবে ৩৬ ইঞ্চি থাকতে, কোমর হতে হবে ২৬ ইঞ্চি, নিতম্বকেও বেপরোয়া হলে চলবে না, ঠিক ৩৬ ইঞ্চিই চাই তোমার। সভ্যতার এতটা পথ পাড়ি দিয়ে, বস্ত্র-সভ্যতার এতকাল পেরিয়ে, মঞ্চে হাঁটতে হবে আধো ন্যাংটো হয়ে! ফটোশুটের জন্য পোজ দিতে হবে! তাও অর্ধ-উলঙ্গ হয়েই! ব্রা-পেন্টি পরে! দুনিয়াজুড়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় এমনটাই রীতি, যা সুশীল দাবিদার কতক পুরুষ তৈরি করেছে। ‘তোমার ত্বক উজ্জ্বল, চোখ বাদামি, ঠোঁট আকর্ষণীয়।’ নিজের সম্পর্কে লোকমুখে এমন মন্তব্য শুনে অভ্যস্ত নারী। নারী-পুরুষ অনেকেই তার চেহারা ও শারীরিক গঠনের সৌন্দর্যে আকর্ষণবোধ করেন, প্রশংসা করেন। এই সৌন্দর্যে তার নিজস্ব কোনো হাত নেই, ভূমিকা নেই। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। তিনি একেক মানুষকে একেক রকম করে তৈরি করেছেন। এই যে বৈচিত্র্য, এটাই সৌন্দর্য। বরং বলা ভালো, প্রত্যেক মানুষই সুন্দর। স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি। সেই সৌন্দর্য নিয়ে প্রতিযোগিতার কী আছে, যাতে নিজের কোনো অর্জন নেই, ভূমিকা নেই! মেয়েরা এগিয়ে আসুক, ভালো কাজের সহযোগী হোক পৃথিবীর মঞ্চে। তবে তা কাপড় খুলে নয়, কাপড় পরে, সম্মানের সঙ্গে, মাথা উঁচু করে। মানুষ নিজে চর্চার মধ্য দিয়ে যা অর্জন করে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হতে পারে। এমনটাই হওয়া উচিত সভ্য দুনিয়ায়। কিন্তু রূপ নিয়ে প্রতিযোগিতা কেন?

লেখক : বিভাগীয় প্রধান; ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

আল জামিআতুল ইসলামিয়া ইসলামপুর, গোপালগঞ্জ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close