অলোক আচার্য

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

বিশুদ্ধ বাতাস এবং আমাদের করণীয়

বায়ুদূষণ পৃথিবীর বহু দেশেরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। বায়ুদূষণ কেবল আমাদের দেশের মাথাব্যথার কারণ না, বরং ভারত, পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর এবং এ রকম জনাকীর্ণ শহরের বড় সমস্যা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে কয়েক মাস ধরেই বায়ুদূষণ চরমে উঠেছে। এর বিরূপ প্রভাব আমরা দেখতে পারছি। বিশে^র সবচেয় বেশি মাত্রার বায়ুদূষণের শহর নয়াদিল্লি। তবে এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ২১২, যা খুবই হতাশাজনক, যা খুব অস্বাস্থ্যকর এবং দিল্লির স্কোর ১৯৬; যা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা দিল্লিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই বায়ুদূষণ কমানোর বিষয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। দূষণের কারণে দিল্লিতে নাগরিক জীবনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন বিশুদ্ধ অক্সিজেন টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। মাত্র ১৫ মিনিট বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে সেখানে প্রায় ৩০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। মানুষ সেখানে যাচ্ছে একটু সময়ের জন্য ফুসফুসে বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়ার জন্য। এমন পরিবেশের কথা মানুষ হয়তো আগে ভাবেনি। যে বিশুদ্ধ বাতাস আজ আমরা বুকভরে নিতে পারছি, কোনো অর্থ খরচ হচ্ছে না; সেখানে বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়ার জন্য টাকা খরচ করতে হবে তাও কোনো নির্দিষ্ট স্থানে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়ার জন্য গাছপালা উপহার দিয়েছেন। প্রতিদিন বিনামূল্যে সেই বাতাস আমরা ফুসফুসে ভরছি। আর আমরা সেগুলো কেটে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছি। আমাদের দেশের অবস্থা এখনো সে পর্যায়ে যায়নি। কারণ আমরা এখনো বিশুদ্ধ বাতাস নিতে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ভিড় করছি না। তবে আমাদের রাজধানী ঢাকাও সেই পরিণতিতেই অগ্রসর হচ্ছে। সেই দিন হয়তো বেশি দূরে নয়; যেদিন একটু সময় বিশুদ্ধ বাতাস পেতে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। দখল-দূষণে রাজধানী আজ বিপর্যস্ত। একটির সমাধান করতে গেলে আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। বলা যায়, ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনোটারই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাগুলো এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

এগুলোর তালিকা তৈরি করলে অনেক লম্বা হবে এবং কোনটির আগে কোনটি সমাধান করা হবে, তা নিয়েই ভজঘট লেগে যাবে। এসব সমস্যা কার্যত এই শহরটাকে অকার্যকর করে ফেলছে। এই শহরে থাকা মানুষগুলো প্রতিদিন সমস্যা নিয়েই বাসা থেকে বের হচ্ছে আবার সমস্যার মাঝেই বাড়ি ফিরছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকামুখী হচ্ছে। এদের অনেকেই আবার সেখানে স্থায়ী বসবাস করার জন্য চেষ্টা করছে। অনেক আগেই ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মেগাসিটি হয়েছে। সেই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এতে আমাদের প্রাণশক্তি গাছপালা কাটা যায় প্রচুর। রাজধানীর ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। আজ সেখানে কংক্রিটের নি®প্রাণ আস্তরণ। মুক্ত বাতাস নেওয়ার মতো জায়গার অভাব সেখানে প্রকট। গাছ কেটে ফেলার পর তা আর লাগানো হয় না। ফলে শহরটা একসময় কেবল কংক্রিটের জঞ্জাল হয়ে পড়ে থাকে। যেখানে গাছপালা নেই, সেখানে কীটপতঙ্গ, পাখি নেই; ফলে সেখানে প্রাণ নেই। শহরের পরিণতি হয় ক্রমেই নিষ্প্রাণ। এই নিষ্প্রাণ শহর হওয়ার পরিণতি থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কংক্রিটের জঞ্জাল সরিয়ে প্রচুর সবুজ বনায়ন করতে হবে। আজ দিল্লি যে সমস্যায় ভুগছে, তা আমাদের জন্যও অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন ঢাকায় বসবাসরত মানুষ যে বাতাস দিয়ে ফুসফুস পূর্ণ করছে, তাতে নানা ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। মিসরের কথাই ভাবুন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, মিসরের মরুভূমি এলাকায় খাড়া বন গড়ে তোলা হচ্ছে। এটা প্রথমবারের মতো। ভবনগুলোতে স্তরে স্তরে ৩৫০টি গাছ লাগানো হবে। শতাধিক প্রজাতির ১৪ হাজার গুল্মও লাগানো হবে। জনজট, যানজট ও বায়ুদূষণের কারণে মিসরের রাজধানী কায়রো মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ফলে নতুন এই এলাকাকে রাজধানী করা হবে।

ইতালীয় স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ স্কেফানো বোয়েরি বলেন, কয়েক হাজার বর্গমিটারব্যাপী বন হবে। বনে পাখি ও পোকামাকড় থাকবে। এসব গাছ, গুল্ম কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করবে এবং অক্সিজেন ছাড়বে। একটা বিষয় স্পষ্ট, মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে আবার শেষে সেই প্রকৃতির কোলেই ফিরে যেতে চাইছে। তাহলে উন্নয়নই যদি প্রথম থেকে পরিকল্পনামাফিক করা হতো; তাহলে আজকে এই পরিণতি বরণ করতে হতো না। প্রকৃতি রক্ষা ব্যতীত যে আমাদের অস্তিত্ব থাকে না, এই সহজ সত্যটি আমরা প্রথমে বুঝতে পারলেও বুঝতে চাইনি। আজ যখন বুঝতে পেরেছি, তখন হয়তো অনেকটা দূরে সরে এসেছি। যদি এখনই নিজেদের বাঁচাতে চাই, তাহলে সবাই মিলে পরিবেশ রক্ষা করতেই হবে। তা রাজধানী হোক আর যেকোনো শহরই হোক। কারণ গ্রামগুলোও আজ আধুনিকতার নামে বিলাসীতার নামে গাছপালা উজাড় হয়ে দালাকোঠায় পূর্ণ হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই অপরিকল্পিত নগরায়ণের কার্যক্রম আজও থামেনি। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, গ্রামীণ সড়কসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজ ইটের পরিবর্তে ব্লকের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত যে সময়োপযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিটি দেশই যেকোনোভাবেই বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে আমাদেরও বসে থাকার সময় নেই। ইটের ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া প্রতিনিয়তই বাতাসে মিশে বিষাক্ত করে তুলছে।

এর আগে ডব্লিউএইচওর তথ্যে জানা গিয়েছিল, বিশে^র যেসব দেশের শতভাগ মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে তার একটি বাংলাদেশ। আর বলাই বাহুল্য যে, আমাদের দেশের অন্য শহরের তুলনায় রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। ঢাকার বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে; যা নিঃশ^াসের সঙ্গে দেহের অভ্যন্তরে পৌঁছে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েই বিষাক্ত বাতাস টানতে হচ্ছে এ শহরের মানুষকে। একদিকে ইট-কাঠের শহর থেকে গাছের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়া; অন্যদিকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া যানবাহনের ধোঁয়া, আশপাশের ইটভাটার ধোঁয়াÑ এসব মারাত্মকভাবে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের জন্ম দিচ্ছে। মিসর কায়রো থেকে অন্যত্র রাজধানী সরিয়ে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচার মধ্যে সমস্যার সমাধান খুঁজছে। একসময় ঢাকার বাতাস যখন মানুষের অনুপযোগী হয়ে উঠবে; তখন আমরা কী করব? এত কিছুর চেয়ে বরং সমস্যা সমাধানের দিকেই মনোযোগ দেওয়া ভালো। বাতাসে যে কারণে আজ বিষ ঢুকে গেছে; সেসব কারণ রোধ করতে হবে। আর অবশ্যই প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। সেক্ষেত্রে ঢাকার প্রতিটি ছাদ বেছে নেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি ছাদেই যদি পরিকল্পনামাফিক বাগান তৈরি করা যায়, তাহলেও কিছুটা সমাধান সম্ভব। রাজধানীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলার জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য কত কিছুই করতে পারছি। তবে প্রকৃতিকে কেন কাছে টানতে পারছি না। নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করছি। প্রবাদে আছে, যে ডালে বসে আছি, সেই ডালটিই যদি কেটে ফেলি, তাহলে সেই ডালের সঙ্গে আমার মাটিতে অধঃপতিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যে গাছপালা আমাদের বুকভরে শ^াস নিতে অক্সিজেন জোগাচ্ছে; সেই গাছ কেটে অক্সিজেনের উৎস নষ্ট করলে আমাদের ধ্বংসও নিশ্চিত।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close