দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২২ নভেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

জলবায়ু পরিবর্তনে সমন্বিত উদ্যোগ চাই

জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবী নামের গ্রহজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রস্তাব পাস হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে। দুনিয়ার ২ শতাধিক দেশের মধ্যে বাংলাদেশই এ ধরনের একটি অনুকরণীয় প্রস্তাব নিল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুনিয়ার যেসব দেশ অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন বাংলাদেশ তার মধ্যে সামনের কাতারে। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মানুষের কোনো ‘পাপ’ না থাকলেও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি তারা। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলো। বায়ুমন্ডল দূষণের কারণে তারা পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। অথচ তাদের পাপের খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো সাগরপাড়ের দেশগুলোকে। সাগরের জলরাশির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব দেশ ডুবে যেতে পারেÑ এমন আশঙ্কার সম্মুখীন।

এ প্রেক্ষাপটে জলবায়ু সংকটের বহুমাত্রিক সমস্যা থেকে বিশ্বের ৮০ ভাগ মানুষকে রক্ষায় সব দেশের পার্লামেন্ট, সরকার, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দ্রুত, কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্তিত্বের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ‘গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হোক’ শীর্ষক প্রস্তাব পাস করেছে জাতীয় সংসদ। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার সংসদের পঞ্চম অধিবেশনের বৈঠকে ১৪৭ বিধিতে আনা এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষে কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। প্রস্তাবটির বিশদ বর্ণনা দিতে সাবের হোসেন চৌধুরী সংসদে সøাইড শো প্রদর্শন করেন।

তিনি বলেন, আমরা হব পৃথিবীর প্রথম ও একমাত্র সংসদ যারা প্লানেটারি ইমার্জেন্সি ঘোষণা করলাম। আমাদের আগামী দিনের রাজনীতি, কূটনীতিতে এ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে এটা উপস্থাপন করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন চলছে বাংলাদেশ তার নেতৃত্ব দিতে পারবে। সংসদে জলবায়ু-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রস্তাব এমন একসময় পাস হলো; যখন জলবায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় হোতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ ব্যাপারে কোনো দায় নিতে অস্বীকার করেছেন। মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতে ঢেকে দিয়েছেন লজ্জার কালো চাদর। বিশ্ববাসীকে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হলে তা হবে এক বড় অর্জন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয় অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। আর এর ফলে এই অঞ্চলে তীব্র পানি সংকটের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। হিমালয়কেন্দ্রিক যে আটটি দেশের ওপর অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রভাব পড়বে, বাংলাদেশও রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে এই সংকট নিরসনে পার্বত্য এলাকায় নগরায়ণের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সুপারিশও করা হয়েছে। সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে এখন থেকে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে হবে।

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশে অসময়ে অনাবৃষ্টি, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়সহ অতি গরম আবহাওয়া তৈরি হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের অনেক এলাকা প্লাবিত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আমাদের উপকূলীয় এলাকা এবং সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারসহ অন্যান্য এলাকা। দেশের জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই জনসংখ্যার জন্য কৃষিজমিতে বাড়িঘর নির্মাণ বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রতিবেদনে হিমালয়ের নগরায়ণ বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ হিসেবে পর্যটন ও তীর্থযাত্রাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ বেড়ে যাওয়ায় ঝরনা ও নদীনির্ভর পানি ব্যবস্থাপনার প্রতি নির্ভরতাও বেড়েছে।

পুরো হিমালয় অঞ্চল ছড়িয়ে আছে ৪২ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে, যা আটটি দেশের মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশগুলো হলো আফগানিস্তান, ভুটান, চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তান। পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর অঞ্চল হিমালয়ের এই দ্রুততর অপরিকল্পিত নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে কোটি কোটি মানুষ গভীর পানি সংকটে পড়বে। হিমালয় পর্বত অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পার্বত্য নগর কেন্দ্রগুলো তাদের পৌর এলাকায় অবস্থিত পানির উৎসগুলো থেকে চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পর্বতে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ভূগর্ভে থাকা পানির ওপর নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। পার্বত্য অঞ্চলে পানির সংকটের পাশাপাশি দূষণ ও মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

এ সংকট সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত কৌশল প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ২০০৯-এ বলতে পেরেছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশের কী করা উচিত, বিশ্বের কী করা উচিত। এ বাস্তবতায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে সহায়তার জন্য প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০। পানি ও পরিবেশবিষয়ক লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে এ পরিকল্পনায় সময়ভিত্তিক সুনির্দিষ্টকরণ করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত তথ্যবহুল ও বিজ্ঞানভিত্তিক একটি পরিকল্পনা, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের সামনে আসলে বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সেসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর উচিত এ ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে কাজ করা।

লেখক : সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close