ইসমাইল মাহমুদ

  ২২ নভেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

গুজবের অলৌকিক গতি

নভেম্বর ১৮। সন্ধ্যায় সারা দেশে গুজব ছড়িয়ে পড়ে দেশে লবণের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর আগে গত মাসাধিককাল থেকে পেঁয়াজ নিয়ে দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজমান থাকায় ‘লবণ’ গুজব বেশ ভালোভাবেই ডালপালা গজায়। দেশের মানুষ এ গুজবে কান দিয়ে সবকিছু ফেলে ছুটতে থাকে বাজারের দিকে। সারা দেশে মুহূর্তেই শুরু হয়ে যায় লবণ নিয়ে হুলোস্থুল কান্ড। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক টাইমলাইনে লবণের আহাজারি! দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণ মজুদ থাকার পরও গুজবের কারণে এ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ে দেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিকের ললাটে। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘লবণ’ সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। কেউ কেউ এ স্মৃতিচারণায়ও বসে যান। দোকানগুলোতে লবণের জন্য মানুষের হুড়োহুড়ি লেগে গেলে কেউ কেউ উচ্চ দামে বিক্রি করেনÑ এমন তথ্যও পাওয়া যায়। তবে সারা দেশে এমন গুজবের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশাসন অত্যন্ত তৎপর হয়ে রাতের মধ্যেই বাজার মনিটরিংয়ে নেমে পড়ে।

আমরা হুজুগে বাঙালি। যদি আকস্মিকভাবে কোনো একটি হুজুগ ওঠে, তবে এই হুজুগে গুজবে কান দিয়ে ছুট দেওয়া শুরু হয় একশ্রেণির মানুষের। আর ওই একশ্রেণির মানুষের কারণেই গুজব কোনো কোনো সময় প্রকৃত সত্যের চেয়েও অধিক পরিমাণে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অনেক সময় দেশে সাজানো নাটক ও সুপরিকল্পিত মিথ্যাচার দিয়ে গুজব সৃষ্টি করে ফায়দা লুটে নেয় একটি অসাধু চক্র। আর এ দুষ্টচক্রের কারণেই গুজব অনেক সময় এমন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে, দেশে নানাবিধ সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। গুজবের কারণে হুজুগে বাঙালির দ্বারা অনেক সময় সাধারণ ও নিরীহ মানুষের জীবননাশের মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। চলতি বছরই পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবেÑ এমন গুজবে দেশব্যাপী এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে, পাড়া-মহল্লায় ‘কল্লাকাটা’ বা ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে বহু জীবনের সলিল সমাধি হয়েছে এবং হত্যা মামলায় অনেক মানুষ কারাবাস করছেন। এজন্য দায়ী হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবÑ এমনটাই মনে করছেন অভিজ্ঞরা।

ডিজিটালাইজশনের এ যুগে স্মার্টফোনে মানুষ সহজেই প্রতি মুহূর্তে ইউটিউব ও স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে মিথ্যা-বানোয়াট ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, প্রতি মুহূর্তে দেশ তথা বিশে^র নানা খবর জানতে পারছে। এসব খবরের অধিকাংশই চরম মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ ও ভিত্তিহীন। অনেক মানুষ সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই এসব খবর বা তথ্য অন্ধের মতো বিশ^াস বা গ্রহণ করছে। আর কিছু কিছু অনুমোদনহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন অনলাইন নিউজ পোর্টাল এসব মিথ্যে খবরের আগুনে যেন ‘ঘি ঢেলে’ দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু মানুষ ‘কান নিয়েছে চিলে’ কথাটাকে বিশ^াস করে কানে হাত নিয়েই চিলের পেছনে ছুটছে।

প্রতিনিয়ইতই যেভাবে দেশে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, এতে খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়, কোনো কোনো দেশবিরোধী মহল বা স্বার্থান্বেষী মহল ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে দেশের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। এটা এখন দেশের সচেতন মানুষের কাছে পুরোপুরিই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সচেতন মহলের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে দেশকে অস্থিতিশীল করতে আন্দোলনসহ নানা উপায় অবলম্বন করে ব্যর্থ হয়ে সরকারবিরোধী কোনো দল ও সংগঠন এমন গুজব ছড়াচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। কারণ বর্তমান সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে স্বার্থান্বেষী একটি মহলের ক্ষমতার স্বপ্ন এখন দিবাস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ওই মহলটি গুজব ছড়িয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য দেশের শান্তি বিনষ্টের অপচেষ্টায় লিপ্ত হচ্ছে না; এমন কথা বলা যাচ্ছে না।

গুজবে কান দেবেন না সরকার ও দেশের সচেতন মহলের পক্ষ থেকে এমন কথা প্রায়ই বলার পরও দেখা যায় গুজব প্রতিটি মানুষের কানে কানে, মুখে মুখে ফেরে। ‘গুজব’-এর গতি যেন আলোর গতিকেও হার মানিয়েছে। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। কিন্তু গুজবের গতি যেন আরো বেশি। হয়তো দেখা গেল, আপনি অত্যন্ত সতর্কভাবে গুজব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু গুজব আপনার পিছু ছাড়বে না। আমরা হলাম হুজুগে বাঙালি। আর হুজুগে বাঙালির কান সব সময় খাড়া থাকে গুজবে। গুজব ছড়ানোতে বিশে^ বাঙালিই সেরা। আমরা তিলকে মুহূর্তেই তাল বানিয়ে ফেলতে পারি। এতে আমাদের হারাবার মতো কোনো জাতি আজও জন্ম নেয়নি। গুজব ছড়িয়ে খুব সহজেই আমাদের কাবু করা যায়! একটি গুজব ছড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই গুজবটির সত্যতা যাচাই না করেই আমরা গুজবের পিছু ছুটি। যা শুনলাম তা কি সত্যি, নাকি মিথ্যেও বেসাতি সেটি পরখ করার প্রয়োজন বোধটুকুও অনেক সময় আমরা করি না। ফলে গুজবকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে একশ্রেণির সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাদের প্রতিনিয়তই বোকা বানিয়ে চলেছে।

দেশে একের পর এক গুজবে মানুষের আজ নাভিশ^াস। গুজবের কারণে মানুষের মধ্যে মানুষ নিয়েও সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে নষ্ট করতে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ খেলছে ‘গুজব’ নামের খেলায়। এসব স্বার্থান্বেষী মানুষের গুজব রটানো ও প্রতারণার জালে জড়িয়ে দেশে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে আইন। চলতি বছরে ছেলেধরা দেশে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। হুজুগে বাঙালি গুজবে বিশ^াস করে অনেক স্থানেই সন্দেহভাজনদের আইনের হাতে তুলে না দিয়ে ছেলেধরা ভেবে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে অনেক ঘটনা আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। যারা গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা করেছেন, তারা ঘটনার সময় একটি পুণ্যের কাজ করেছেন বলে ধারণা করে নিজের মনকে তৃপ্তির আবেশে ভরিয়ে তুলেছেন। কিন্তু তাদের মোহভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। আইন নিজের হাতে তুলে নিরীহ মানুষকে হত্যার অপরাধে অনেকেই আজ অবধি কারান্তরীণ। ঘটনার সময় কারো মনে কি প্রশ্ন জাগেনি অপরাধী বা আসামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দেশে প্রচলিত আইন আছে, আদালত আছে। এ প্রশ্ন কী জাগেনি আমি কেন তাকে হত্যা করতে যাব? এতটুকুও কী ভাবনায় আসেনি আমাকে তো কেউ মানুষ মারার লাইসেন্স দেয়নি। ওই সময় মাথাকাটা গুজব ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত ৬০টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও ২৫টি ইউটিউব লিংক এবং ১০টি ওয়েব পোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে। এসব ফেসবুক ও ইউটিউব লিংকের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। অবাক হওয়ার বিষয়, মানুষ এতটা নির্বোধ হয় কীভাবে? গুজবের গণপিটুনিতে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের কেউই ছেলেধরা ছিল না।

ছেলেধরা বা কল্লাকাটা গুজবের কিছুদিন আগের ঘটনার দিকে তাকালে দেখতে পাই, ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে নয়ন বন্ডের মতো সন্ত্রাসী ও তার দলবল প্রকাশ্যে যখন কুপিয়ে হত্যা করে তখন শত শত মানুষ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখেছিল! কেউ বিন্দু পরিমাণ প্রতিবাদ করেনি বা রিফাতকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। অথচ এর কিছুদিন পরই রাজধানীর বাড্ডা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে ভর্তি যাওয়ার পর ছেলেধরার ভুয়া গুজবে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় এনে শত শত মানুষ প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করল তাসলিমা

নামের নিরীহ এক নারীকে! এই তাসলিমা একজন মা এবং তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে এসেছেন, তা কেউ যাছাই

করার চেষ্টাও করল না। গুজবের কারণে হুজুগে বাঙালি একজন নিরপরাধ নারীকে নিমর্মভাবে পিটিয়ে হত্যা করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল!

‘ফেমে’ বা ‘ফামা’ নামে প্রাচীন গ্রিসে একজন দেবীর কথা লোকমুখে প্রচলিত। তিনি ছিলেন ‘গুজব’-এর দেবী। গোড়ায় তিনি ছিলেন ছোটন। এক সময় বাড়তে বাড়তে তিনি আকাশ ঢেকে দিলেন। তার মুখখানা ঢাকা থাকল মেঘের আড়ালে। তাকে দেখা যেত না, শোনা গেল কণ্ঠস্বর। আর তা দিয়ে তিনি সর্বত্র ছড়িয়ে বেড়াতেন বিপজ্জনক সব গুজব। এ গল্পটি গ্রিসে এখনো ব্যাপক প্রচলিত। এখনো গ্রিসের মানুষ মনে করেন দেবী ফামা অর্ধসত্য আর ডাহা মিথ্যে কথার রানি ছিলেন। আর বর্তমান স্মার্টফোন জেনারেশন এসে আমাদের দেশের কিছু সুবিধাবাদী মানুষ দেবী ‘ফামা’র পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। এখন আমাদের দেশের সুযোগ সন্ধানীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মেঘের আড়ালে আত্মগোপন করে বিদ্যুতের বেগে গুজব ছড়াতে সিদ্ধহস্ত। আমাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা শত শত বছর ধরে চলমান। এটির কারণ বিরোধ-প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের রাজনীতি। সুযোগ সন্ধানীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে গুজবের ডালপালা ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই বিষবাক্য সন্ত্রাস বন্ধ করতে প্রয়োজন আইনের কঠোর ব্যবস্থা। তবে তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার উন্নয়ন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close