আবু আফজাল সালেহ

  ২০ নভেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি

জাবিতে শিক্ষকের ওপর ছাত্রদের হামলার ঘটনা। এ রকম ঘটনায় সাধারণত শিক্ষকের একাংশ উসকানির মদদদানকারী হিসেবে জড়িত থাকেন। তাই বলা চলে, শিক্ষক শিক্ষকের অবস্থানে নেই। তাদের একাংশ ক্ষমতা নিতে চান। ভবিষ্যতে লাভজনক পদ পেতে আগ্রহী। নীতিনৈতিকতার ধার ধারেন না অনেকে। ফলে অনেক সময় ছাত্রসংগঠনের লেজুড়বৃত্তি করে থাকেন। ক্ষমতাসীন সংগঠনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি হয়। দেখা যায়, নিজের ছাত্রদের (ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতা) তোয়াজও করে থাকেন। এদের সন্তুষ্টির জন্য বেশির ভাগ সময় নষ্ট করেন, ব্যবহার করেন। ফলে রিমোট কন্ট্রোল শিক্ষকের হাতে থাকে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অশুভ শক্তির হাতে চলে যায়।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্র ও শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। এটি মধুর সম্পর্ক হওয়ার কথা। শিক্ষক কী অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারছেন? ছাত্ররা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে কেন? এ রকম নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। রাজনীতি দায়ী কি? না লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি দায়ী?

শিক্ষক কেন নীল-সাদা দলে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন? সন্তানতুল্য ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না কেন? নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলছেন কেন? তদবিরে নিয়োগ পেলে মনোবল থাকে না! তদবিরকারীর কথামতো চলতে হয়। নিজের পায়ে চলা যায় না। মেরুদন্ড সোজা করে হাঁটা যায় না! বেশির ভাগ শিক্ষক কি এ কাতারে পড়বেন?

আগেরকার শিক্ষকের ছাত্র-অভিভাবক অনেক সম্মান করতেন। কিন্তু এখনকার বেশির ভাগ শিক্ষক কাক্সিক্ষত মর্যাদা পান না! আগেকার বেশির ভাগ শিক্ষকের মনে জোর ছিল, ছিল ছাত্রদের ওপর কমান্ডিং-ক্ষমতা। এখন ঠিক উল্টো হয়ে গেছে! ভাবার বিষয় এটি। ছাত্ররা কেন অবক্ষয়ের শিকার। একটু স্বার্থ বা ঠুনকো কাজে অনৈতিক কাজও করে থাকেন। শিক্ষকের ওপর মানসিক নির্যাতন থেকে শারীরিক নির্যাতন পর্যন্তও হচ্ছেন। পুকুরে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত চলে গেছে এ অসহিষ্ণুচর্চা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতারা যা বলেন, সেটাই বাস্তবায়ন করতে হয় শিক্ষককে। এ ব্যর্থতার দায় শিক্ষক না ছাত্রর। উভয়পক্ষের দায় হলেও অভিভাবক হিসেবে শিক্ষকই দায়ী বেশি মনে করি। অনৈতিক ও অনিয়মে নিয়োগপ্রাপ্তরা বেশি দায় নিতে বাধ্য। এ রকম প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেলে কমান্ডিং ক্ষমতা পাওয়া যায় না! নিজের স্বার্থের জন্য অন্যায়-অনিয়ম অনেক শিক্ষক করে থাকেন। নম্বর বেশি দেওয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছুই হয়। চরিত্রের স্খলনও হয়। যারা জানেন, তারা সে শিক্ষককে কেন মানবেন?

শিক্ষকরা স্বার্থ বা রাজনৈতিক বিবেচনায় দ্বিধাবিভক্ত। অনেক সময় রাজনৈতিক বা তদবিরকারী গ্রুপের কমিটমেন্ট বাস্তবায়ন করতে বাধ্য। একটু এদিক-ওদিক হলেই বিপত্তি বাধে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজবও ছড়ানো হয়। এডিটিং করে ছবি বা ভিডিও আপলোড করে ইচ্ছাকৃতভাবে চরিত্রহনন করার চেষ্টাও করা হয় অহরহ। বাছবিচার না করেই দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় দেশ। ভালো কাজ করেও অনেক শিক্ষক বা নেতা বিতর্কিত হয়ে যান! এ কারণে অনেকে ভালো উদ্যোগ নিতেও ভয় পান! এ সমাজে নিরপেক্ষতা থাকা খুবই কঠিন। দিন দিন ছাত্ররা কেন অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছেন! লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিও দায়ী অনেকাংশে। অনুসরণ করার মতো শিক্ষকও কম পাওয়া যাচ্ছে। ভালো অবস্থার সংকট চলছে। শিক্ষকের বড় অংশ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত। অনেকে ছাত্রদের স্বার্থে কাজ না করে নিজের উন্নতির জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছেন। অনৈতিকদের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে নিচ্ছেন বা তারা হাতিয়ার/গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের দুর্বলতা আছে। কারো কৃপায় চেয়ারে বসলে রিমোট কন্ট্রোল অন্যের হাতে থাকাটাই স্বাভাবিক।

দেখা যায় যে, এক শিক্ষক তার সহকর্মী অন্য শিক্ষককে ভালো চান না। শুধু নিজের ভালো দেখতে চান। কিছু ব্যতিক্রম বাদে এ দৃশ্য কমন। ফলে গ্রুপিং বেশি হয়। নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস চলে আসে। এর ফলে অন্য শক্তি শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায় যে, কোনো কোনো শিক্ষকের লেকচার আর বাস্তবজীবনের মধ্যে বিরাটই গ্যাপ। এটা ছাত্রসমাজ বা অন্য কেউ জেনে ফেললে শিক্ষকের সামাজিক মূল্যায়ন কমে যায়। এ নেতিবাচক দৃশ্য প্রায়ই এখন ঘটে থাকে। ফলে পুরো শিক্ষক ন্যায্য সম্মান বা পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করি। ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্কে আজ অশুভ ছায়া পড়েছে। বলা যায়, ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে। এর জন্য আসলে কেউই লাভবান হচ্ছেন না। সাধারণ ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হচ্ছেন। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নাম হচ্ছে। বিশ্বে আমরা অসভ্য জাতি হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এ থেকে উত্তরণ হতেই হবে। শিক্ষককে গুরুজন হিসেবে মেনে নিতেই হবে। চেয়ারে বসে শিক্ষকদেরও মূল্যায়ন করতে হবে। এ জায়গায়ও পিছিয়ে। আমলাতান্ত্রিকতায় হেরে যাচ্ছেন শিক্ষক। এখানে তাদের দুর্বলতাই কাজে লাগানো হচ্ছে বলে মনে করি। শিক্ষক সমাজ সচেতন হয়ে আলো বিতরণ করলে বর্তমানের অস্বাভাবিক অবস্থাকে স্বাভাবিক করতে বেশি সময় লাগবে না! আমরা ফিরে পেতে চাই, ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্ক, সন্তান-অভিভাকক সম্পর্ক আগের মতো হোক।

অনেকে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে। অনেকে অভিমান করে এমন কথা বলে থাকেন। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আমাদের ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে পজিটিভ সব আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অনেক। ছাত্ররাজনীতির ভূমিকাই সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এসব দিকও আমাদের খেয়ালে রাখতে হবে। তবে পদ্ধতিগত সংস্কার করা যেতে পারে। জাবির মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বা বন্ধ ঘোষণা, বিভিন্ন সময়ে ভিসি/শিক্ষক নেতাদের অপ্রত্যাশিত বক্তব্য, ছাত্র কর্তৃক অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দেওয়া, শিক্ষক লাঞ্ছিত ইত্যাদি নেতিবাচক ঘটনা আর দেখতে চাই না! সবার সুমতি হোক।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close