নিতাই চন্দ্র রায়

  ১৯ নভেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বাম্পার ফলনেও কৃষকের মুখে হাসি নেই

সারা দেশে এখন আগাম জাতের আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষকের উঠানে সোনালি ধানের ছড়াছড়ি। আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই পুরোদমে শুরু হবে আমন ধান কাটার উৎসব। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার নওধার গ্রামের নজরুল ইসলাম নামের এক কৃষক এবার আমন মৌসুমে এক একর জমিতে ব্রিধান ৫৭ জাতের চাষ করেন। একরপ্রতি তার ফলন হয়েছে ৩২ মণ। বর্তমানে ময়মনসিংহের হাটবাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৬২০ টাকা দরে। সে হিসাবে ৩২ মণ ধানের দাম ১৯ হাজার ৮৪০ টাকা। তার প্রতি একর জমিতে আমন ধান চাষে খরচ হয়েছে ১৯ হাজার ২০০ টাকা। একরপ্রতি লাভ মাত্র ৬৪০ টাকা। এভাবে কৃষক বাঁচে কীভাবে? ওই গ্রামের অন্য এক কৃষক মো. তমিজ উদ্দিন বলেন, খোলাবাজারে প্রতি মণ ধানের দাম কমপক্ষে ১ হাজার টাকা হওয়া উচিত।

আমরা জানি, দেশে উৎপাদিত চালের শতকরা ৪০ ভাগ পাওয়া যায় আমন মৌসুমে। আমন ধান চাষের সুবিধা হলো বোরো ধানের মতো এই ধান চাষে তেমন সেচ ও সারের প্রয়োজন হয় না। আমন ধানের উৎপাদন খরচ কম। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এ বছরও আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। তার পরও কৃষকের মুখে হাসি নেই। পত্রিকায় প্রকাশিত খরব থেকে জানা যায়, সারা দেশের হাটবাজারে প্রতি মণ আমন ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। এ দামে ধান বিক্রি করে কৃষকের প্রতি মণে লোকসান হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। চালের বৃহত্তম মোকাম নওগাঁয়ে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন চালের দাম কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা বৃদ্ধি পেলেও ধানের দাম বৃদ্ধির কোনো সুখবর নেই। কৃষকের মনে ভয়। শত প্রশ্নÑ বোরো মৌসুমের মতো আমন মৌসুমেও তারা ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন কি না?

এবার আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে। এ পরিমাণ জমি থেকে ১ কোটি ৫৩ লাখ টন চাল বা ২ কোটি ৫ লাখ টন ধান উৎপাদিত হতে পারে। গত বছর আমন উৎপাদিত হয় ১ কোটি ৪০ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, এ বছর প্রতি কেজি আমন ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ২১ টাকা ৫৫ পয়সা। গত ৩১ অক্টোবর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সরকারের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, আসন্ন আমন মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান ও চাল সংগ্রহ করবে সরকার। এর মধ্যে ৬ লাখ টন ধান সংগ্রহ করা হবে প্রতি কেজি ২৬ টাকা দামে প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে। এ ছাড়া সাড়ে ৩ লাখ টন সেদ্ধ চাল ও ৫০ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হবে চুক্তিবদ্ধ মিলারদের কাছ থেকে। সেদ্ধ চালের দাম ৩৬ টাকা ও আতপ চালের দাম নির্ধারণ করা হয় ৩৫ টাকা প্রতি কেজি। ২০ নভেম্বর থেকে ধান কেনা শুরু হবে। আর চাল কেনা শুরু হবে ১ ডিসেম্বর থেকে। এ কার্যক্রম চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ নভেম্বরের মধ্যে কৃষকের তালিকা ইউনিয়ন পরিষদে জমা দিতে হবে, তারপর যাচাই-বাছাই করে তা চূড়ান্ত করা হবে। যদি কৃষকের সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন লটারির মাধ্যমে কৃষকের তালিকা তৈরি করা হবে। লটারির মাধ্যমে বাদ পড়া কৃষক বোরো মৌসুমে অগ্রাধিকার পাবেন। এর আগে ইউনিয়ন পর্যায়ে যারা এই ধান-চাল সংগ্রহ করা নিয়ে দুর্নীতি করেছেন, তাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এবং কঠোর মনিটরিং করা হচ্ছে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না বলে জানান কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। তার বক্তব্য থেকে আরো জানা যায়, গ্রাম পুলিশ বা চৌকিদাররা যাতে সারা বছর ১০ টাকা কেজি দরে চাল কিনতে পারেন, সে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় বৈঠকে। পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বছরে ৫ মাসের যে নিয়ম ছিল, তা বাড়িয়ে ৭ মাস করা হয়েছে। সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, ১২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৪৭ টন চাল এখন পর্যন্ত সরকারি গুদামে মজুদ রয়েছে। চলতি মৌসুমে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে কৃষক এবার ফসল নিয়ে আর বিড়ম্বনায় পড়বেন না। ধান চাষকে লাভজনক করতে হলে সেচ ও সারে সরাসরি প্রণোদনা দিতে হবে প্রান্তিক কৃষককে। এতে ধনী, গরিব, প্রান্তিক সব কৃষকই উপকৃত হবেন। কৃষিকে নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করতে হলে শস্য বহুমুখীকরণ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। এ বছর গতবারের চেয়ে তিন সপ্তাহ আগে ঘোষণা করা হলো আমন ধান-চালের সরকারি সংগ্রহ মূল্য। আগে আমন মৌসুমে ধান কেনা হতো না। এ বছর প্রথম কেনা হচ্ছে। গত বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল দেড় লাখ টন। কিন্তু চাষিরা ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ৪ লাখ টন ধান কেনা হয়েছে কৃষকের কাছ থেকে। সরকারি গুদামে ধান সংগ্রহে তালিকায় যাদের নাম থাকবে, তারা সত্যিকারের কৃষক কি না, তার মনিটরিং আরো জোরদার করা হবে। কৃষকের ধান কাটার মেশিন দেওয়ার জন্য ৫০০ কোটি টাকা চেয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সারের দাম কমানোসহ উৎপাদন খরচ কমানোর কথা বিবেচনা করছে সরকার। চাষিরা যখন সরকারি গুদামে ধান নিয়ে যান, তখন গুদাম কর্মকর্তারা বলেন, ধানে আর্দ্রতা বেশি। ফলে কৃষকের হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ধরনের হয়রানি থেকে কৃষকের বাঁচানোর জন্য প্রতি ইউনিয়নে একটি করে ময়েশ্চার মাপার মেশিন বা ধানের আর্দ্রতা পরিমাপের যন্ত্র সরবরাহ করবে সরকার। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা ধানের আর্দ্রতা মেপে কৃষকের সহযোগিতা করবেন। এ বছর আমনে পুরোটা না পারলেও আগামী বোরো মৌসুমে ধানের আর্দ্রতা নিয়ে যাতে কোনো সমস্যা না হয় বা কৃষকের যাতে ভোগান্তি না হয়; সেজন্য ব্যবস্থা নেবে সরকার।

সরকারি গুদামে ধান-চাল-গম কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে খাদ্য অধিদফতর ‘কৃষি অ্যাপস’ নামে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) ‘কৃষক অ্যাপস’ তৈরির কাজ শেষ করেছে। খাদ্য অধিদফতর এবার ৮ বিভাগে ১৬ উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এ অ্যাপস ব্যবহার করে আমন সংগ্রহ করবে। এর ফলে তালিকাভুক্ত যেকোনো কৃষক অ্যাপসে প্রবেশ করে জমির পরিমাণ, ফসলের নাম এবং সেই ফসল কী পরিমাণ বিক্রি করতে চান, তা জানাতে পারবেন। শস্য বিক্রির টাকা সরাসরি চলে যাবে কৃষকের অ্যাকাউন্টে। কৃষকের আবেদনগুলো লটারির মাধ্যমে চূড়ান্ত করবেÑ এ সংক্রান্ত কমিটি। কী পরিমাণ শস্য কেনা হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হবে মনোনীত কৃষককে এসএমএসের মাধ্যমে। জমির পরিমাণের তুলনায় বেশি ধান বিক্রি করলে, তা প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য দুর্নীতির মামলা মোকাবিলা করতে হবে সংশ্লিষ্ট কৃষককে। এ নতুন পদ্ধতিতে ধান-চাল-গম কেনা হলে পুরো ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য সরবরাহে কৃষকের আর মধ্যস্বত্বভোগী, রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারস্থ হতে হবে না। খাদ্যশস্যের বর্তমান ক্রয় পদ্ধতিতে প্রকৃত কৃষক তাদের ধান-চাল-গম ন্যায্যমূল্যে সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারেন না। মিল মালিক, ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও মধ্যস্বত্বভোগীরাই এ পদ্ধতিতে বেশি লাভবান হন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে এ অনিয়মের অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে কৃষকের দুর্নীতি করার সুযোগও থাকবে না, কারণ কোনো কৃষক জমির পরিমাণের তুলনায় বেশি ধান বিক্রি করলে সরকারি অর্থ আদায়ের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। ‘কৃষক অ্যাপস’ এর মাধ্যমে খাদ্যশস্য কেনাকাটায় একটা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া এবং সরকার ও কৃষক উভয় পক্ষের দুর্নীতি রোধে সহায়ক হবে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীন ১৫টি চিনিকলে ই-পুর্জি ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আখের মূল্য প্রদানের কর্মসূচি চালু হওয়ার ফলে আখচাষিরা যেমন আখ বিক্রি ও সময়মতো এর মূল্যপ্রাপ্তির ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তেমনি সারা দেশে ‘কৃষক অ্যাপস’ চালু হলে অবহেলিত কৃষক সমাজ প্রতি বছর তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য নিয়ে যে ভোগান্তি শিকার হয় তার অবসান হবে। ধান চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়বে। হেক্টরপ্রতি ফলন বাড়বে। টেকসই হবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা।

এবার দেশে আমন মৌসুমে ধান উৎপাদিত হবে প্রায় ২ কোটি টন। সরকার কৃষকের কাছ থেকে কিনবে মাত্র ৬ লাখ টন। অর্থাৎ উৎপাদিত ধানের মাত্র শতকরা ৩ ভাগ। সরকারিভাবে এ সামান্য পরিমাণ ধান ক্রয়ে বাজারে ধানের দামের ওপর তেমন প্রভাব পরিলক্ষিত হবে বলে মনে হয় না। ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে কমপক্ষে উৎপাদিত ধানের ২০-২৫ শতাংশ কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close