ড. মিহির কুমার রায়

  ১৯ নভেম্বর, ২০১৯

মতামত

অর্থনীতি, উন্নয়ন বিতর্ক ও দারিদ্র্যবিমোচন

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তিত হওয়ার পর বিশেষত ১৯৬৮ সালের পর থেকে উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে মাত্র দুবার। যদিও বিষয়টি একেবারেই প্রায়োগিক অর্থনীতির বিষয়। প্রথমবার পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছেন বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য কুমার সেন। যিনি দুর্ভিক্ষ, মানব উন্নয়ন তত্ত্ব, জনকল্যাণ অর্থনীতি ও দারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কার্যকর বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। আর অর্থনীতির একই শাখায় দ্বিতীয় পুরস্কারটি পেলেন অর্থনীতিবিদ ত্রয়ী অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। এস্তার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার ২০১৯ সালে তাদের উন্নয়ন অর্থনীতির গবেষণায় (Randomised Control Trial) পদ্ধতি ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি করেছেন বিভিন্ন মহলে। কারণ প্রস্তাবিত গবেষণায় ব্যবহৃত RCT পদ্ধতি নিয়ে এমনিতে কেতাবি অর্থনীতিবিষয়ক গবেষকদের মধ্যে বাদানুবাদ তুঙ্গে রয়েছে। এ ব্যাপারে পিকিং ইউনিভার্সিটির চীনা সেন্টার ফর ইকোনমি ও ন্যাশনাল স্কুল অব ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক ইয়াও ইয়াং মনে করেন, উন্নয়ন গবেষণা সমসাময়িক কালে RCT পদ্ধতি অনেকটাই সনাতন।

এই প্রসঙ্গে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ পেই কাং চাং, রয় এফ হ্যারোড, ইভজি ডোমার ও রাবর্ট সলো গবেষণা করে দেখিয়েছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দেশীয় সম্পদ বৃদ্ধি খুবই জরুরি; যা কৃষিকাজে নিয়োজিত কৃষকও জানেন যে, সঞ্চয় উন্নত জীবনের জন্য জরুরি। কৃষিজমি কিংবা কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে শক্তি জোগায় কিংবা উচ্চতর ফসল ফলাতে সহায়ক। চীনের অর্থনীতিতে দুটি কাজ সংঘটিত হয়েছে যেমন একটি শ্রম নিবিড় রফতানি দিয়ে শুরু করে ক্রমান্বয়ে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন বিকাশের সমন্বয় ঘটিয়েছে এবং এই ব্যবস্থায় চীন বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ সক্ষম উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে অদ্যাবধি খুব কম উন্নয়ন অর্থনীতিবিদই গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। সে যাই হোক, চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যকে প্রায়ই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ বিকশিত পদ্ধতির আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখা হয়। আর RCT ও সমকালীন উন্নয়ন অর্থনীতি এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। উলিয়াম ইস্টার্নি এই পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেন, এই পদ্ধতি উন্নয়নের বড় প্রশ্নগুলোর সমাধান দিতে পারে না; বিশেষ করে সমষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থা জুড়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠান কিংবা পলিসি তৈরি করা যায়। এই মতামতের জন্য অর্থনীতি পলিসি যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক শুদ্ধাচার। এর বিপরীতে জেফরি স্যাক্স বলেন, দুর্নীতির মধ্যেই নিহিত আছে দারিদ্র্যের ফাঁদ; যা ভেঙে ফেলে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে হবে। কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা; যার ফলে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয়। এখন আসা যাক দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে উন্নয়ন অর্থনীতি মডেলের ব্যাপকতা নিয়ে কিছু সফল প্রায়োগিক গবেষণার প্রয়াস; যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক মডেল তার মধ্যে অন্যতম, যা একটি দারিদ্র্যবিমোচনে প্রায়োগিক গবেষণার ফসল। এই মডেলটি হলো, একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের কর্মসূচি; যা দরিদ্রদের কর্মসংস্থানে, আয়বর্ধনে ও জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল সত্যি, কিন্তু এই কর্মসূচিতে যেসব সুফলভোগী নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গঠন করতে পেরেছে, তারাই সফলতা পেয়েছে, যদিও এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিশেষত মানবিক দারিদ্র্য নিয়ে। যদিও এই মডেলটি ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, উন্নয়ন অর্থনীতিতে নয়। তাহলে কি দারিদ্র্যই শান্তির প্রধান শত্রু, যার নিরসন হলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে? তাহলে সাম্প্রতিক নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষকের ফলাফলের সঙ্গে এসব গবেষণার ফলাফলের ভিন্নতা কোথায়?

নোবেল কমিটির বিবেচনায় হয়তো নতুনত্ব রয়েছে; যা আলোচনার দাবি রাখে। বৈশ্বিক দারিদ্র্য লাঘবে পরীক্ষামূলক জঈঞ পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য ত্রয়ী গবেষককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়; যা এদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি এখন উন্নয়ন আর্থনীতির দারিদ্র্য গবেষণায় কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে। ২০০৩ সালে পভার্টি অ্যাকশন ল্যাবরেটরি স্থাপন করে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে গবেষণা চালানো হয় দারিদ্র্যবিমোচন ছাড়াও কৃষি, শিক্ষা, জ্বালানি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও সুশাসনে। এই গবেষকদের গবেষণায় বিগত তিন দশকে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে বেশি লাভবান হয়েছে অতি গরিব ও অতি ধনী শ্রেণি বিশেষত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও চীন দেশের দরিদ্ররা। এই গবেষকরা মনে করেন, দারিদ্র্য কেবল অর্থের টানাটানি নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যার বহুমাত্রিক নিরসন দরকার, যা উন্নয়ন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন গরিব মানুষ কী বলছে, কেমন আচরণ করছে, কীভাবে চিন্তা করছে। ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প হয়তো দারিদ্র্যবিমোচনে নেই। কিন্তু তা বন্ধ হয়ে গেলে যে অনেক বিকল্প পথ বেরিয়ে আসবে, তা বলা দুষ্কর।

সঞ্চয় নিয়ে দারিদ্র্যের উদ্বেগ রয়েছে, যা একটি কাঠামো মাধ্যমে আনা সম্ভব। যেমন গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক সঞ্চয়ের সংগ্রহ তথা ব্যবহারে সাফল্য দেখিয়েছে। বৈশ্বিক দারিদ্র্যবিমোচন পরীক্ষামূলক পদ্ধতির (RCT) সফলতা দেখিয়ে তিনজন নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন, যা হয়ে উঠেছে উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য সফল দৃষ্টান্ত। অভিজিত ব্যানার্জি ও এস্তার দুফলোর লেখা চারটি গ্রন্থের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত Poor Economics : A Radical Rethinking of the Way to Fight Global Poverty; যা গোল্ডম্যান সাচস বিজনেজ বুক সম্মানে ভূষিত হয়েছে। শ্রী অভিজিতের আরো একটি প্রখ্যাত গ্রন্থ হলো- What the Economy Needs Now বইটির মুখবন্ধে লেখা হয়েছে, গরিব মানুষ যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তা কয়েকটি স্তরে অগরিবদের চেয়েও ভিন্ন হয়Ñ যেমন গরিব শ্রেণি যুক্তিপূর্ণভাবে চিন্তা করে কাজ করে, যাতে কোনো ভুলভ্রান্তি না হয়। হলে তার খেসারত দিতে হয় যা ধনীরা করে না। বিশ্বের সরকারগুলো গরিব উন্নয়নে অনেক ডলার ব্যয় করে (তার সঙ্গে অনেক বেসরকারি সংস্থাসহ দাতব্য সংস্থা) কিন্তু সেসব সংস্থা যেসব ধারণার ভিত্তিতে কাজগুলো করে; সেগুলোর ফল ইতিবাচক হলে বলা হয় অপরিপক্ব দৃষ্টিভঙ্গির ফল। এ ক্ষেত্রে গবেষকরা RCT ব্যবহারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে ভারতসহ বিশ্বের আরো ছয়টি দেশে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে দেখিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অন্য কারোর মতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও গরিবের জীবন ভিন্নরূপ ধারণ করে কেন?

দেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নোবেল বিজয়ী অভিজিতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে অর্থাৎ তাদের ব্যবস্থাপনাপত্র বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য যেমনÑ এক. পণ্যের চাহিদা বাড়াতে হলে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে সক্ষম করে তুলতে হবে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে এবং টাকা, চাহিদা বৃদ্ধি, ক্রয়-বিক্রয়, বাজার সম্প্রসারণ ইত্যাদির দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে; দুই. চাহিদার অভাব অর্থনীতির জন্য সমস্যা এবং গরিবদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তিন. মধ্যবিত্ত ও গরিবদের হাতে অর্থ দিতে হবে এবং ধনীদের হাতে টাকা দিলে বৈষম্য বাড়াবে; যা কল্যাণের অর্থনীতি না হয়ে প্রেষণের অর্থনীতি হবে; চার. রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে; যা গরিব মানুষের কোনো কাজে আসে না; পাঁচ. ভ্রান্ত পরিসংখ্যান অর্থনীতি পরিকল্পনার জন্য খুবই ক্ষতিকর; যা ডেটা প্রস্তুতকারীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের জন্ম দেয়; যা কমবেশি বাংলাদেশেও রয়েছে যেমন পেঁয়াজের তথ্য নিয়ে বিবিএস ও কৃষি বিভাগ কিংবা প্রাণী (গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস, মুরগি) সম্পদের ডেটা নিয়ে বিবিএস ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ কিংবা জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে মতবিরোধ ইত্যাদি; ছয়. নোবেলপ্রাপ্তির ঘোষণা ভালো শোনায় যার একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে বলে সরকার কিছু মূল্যায়ন না করেই পলিসি ঘোষণা করে এবং পলিসি মূল্যায়ন হয় না; যা এই অর্থনীতিবিদ বিরোধিতা করেন।

এখন প্রশ্নটি হলো- গবেষকদের মতে, গরিবরা গরিব শুধু তাদের বৈষয়িক অবস্থার কারণে নয়, এর মূলে রয়েছে তাদের ওপরে ওঠার উচ্চাকাক্সক্ষার অভাব। একবার এই আকাক্সক্ষাকে প্ররোচিত করতে পারলেই সেটা ক্ষুদ্র প্রণোদনা দিয়েই অর্জন সম্ভব। দারিদ্র্যের মৃদুমন্দ চলকের বৃহৎ উল্লম্ফনের পরিবর্তন করা যায়। এর জন্য অর্থনীতিবিদ বলেছেন, উদ্বুদ্ধকরণে অর্থনীতি ভূমিকা রাখতে পারে; যার মাধ্যমে গরিব মানুষের সাধারণ কার্যকলাপের ধারণা-ধরন পরিবর্তন করা সম্ভব, যাতে তারা দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে পারে। আমাদের দেশের জন্য একটি সুখবর হলো, গত দশ বছরে প্রায় ১ কোটি লোক হতদরিদ্রের অবস্থা কাটাতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যায়, এসডিজি লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত হবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close