এহসান বিন মুজাহির

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৯

জিজ্ঞাসা

ট্রেন ভ্রমণের নিরাপত্তা ফিরবে কবে

আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যমের নাম রেলব্যবস্থা। উন্নত বিশ্বে রেলব্যবস্থা সর্বাধিক জনপ্রিয়। আমাদের বাংলাদেশেও যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়কপথের তুলনায় রেলপথে ভ্রমণ করা নিরাপদ এবং আরামদায়ক। ট্রেনে ভ্রমণ করতে কষ্ট যেমন কম, তেমনি খরচও সাধ্যের মধ্যে। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নি¤œবিত্ত পর্যন্ত সব শ্রেণির মানুষই ট্রেনে ভ্রমন করাকে আরামদায়ক ও নিরাপদ মনে করেন। সিলেট-ঢাকা এবং সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে প্রতিদিন চলাচল করে একাধিক ট্রেন। উদয়ন, পাহাড়িকা, জয়ন্তিকা, উপবন, কালনী, জালালাবাদ প্রভৃতি এক্সপ্রেস ট্রেন চলে এসব রুটে। সড়ক দুর্ঘটনার কবল থেকে বাঁচতে চলাচলের অন্যতম বাহন হিসেবে ট্রেনকে সবাই বেছে নেয়। অথচ রেল যোগাযোগব্যবস্থা আজও পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হতে পারেনি। স্বাচ্ছন্দ্য আর নিরাপদে যাতায়াতের অন্যতম নিরাপদ বাহনে এখন নেই দুর্ঘটনামুক্ত ভ্রমণের নিরাপত্তা। এখন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে রেলপথও। বর্তমানে ট্রেন দুর্ঘটনার হার দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় ট্রেনেও ঝুঁকি বাড়ছে। কোনোভাবেই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় রেলের ওপর থেকে ভরসা হারিয়ে ফেলেছে সাধারণ মানুষ।

এ সময়ে রেল হয়ে উঠেছে আতঙ্কের অন্য নাম। বিশেষ করে রেলপথের সিলেট রুট হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ১৬ জন। গত ১২ নভেম্বর রাত পৌনে ৩টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা আর সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের ভয়াবহ সংঘর্ষে কয়েকটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে ১৬ জন নিহত হয়েছে ও শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছে। এ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখে কারো কোনো অবহেলা থাকলে; সে অনুযায়ী যথার্থ ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। এর আগে কুলাউড়ায় ভয়ংকর রেল দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৪০৯টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২৬২ জনের। বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৯৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগাতি রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় রেলযুগের। বিভিন্ন বাধা কাটিয়ে মানুষের সহজলভ্য যাতায়াতের ভরসায় পরিণত হয় ট্রেন যোগাযোগ। কিন্তু গত কয়েক বছরে থামছেই না রেল দুর্ঘটনা। প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও রেল দুর্ঘটনা ঘটছে। বাস্তবে রেল কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে ট্রেন দুর্ঘটনা। প্রতি বছর এ হার বেড়েই চলছে।

গত ২৩ জুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন উপবন এক্সপ্রেস ব্রিজ ভেঙে খাদে পড়ে ৭ জন নিহত হয়েছে এবং আড়াই শতাধিক আহত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বিগত নয় মাসে রেলের সিলেট রুটে অন্তত ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত ২০ জন। এ সময়ে দেশের অন্য কোনো রেলরুটে এত দুর্ঘটনা ঘটেনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় রেল দুর্ঘটনায়ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে রেলের পক্ষ থেকে মোট চারটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের পক্ষে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় রেল দুর্ঘটনার পরও গত ২৪ জুন তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কমিটির প্রধান করা হয়েছিল রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে। এই কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে ঘটা দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে রেল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এর স্থায়ী সমাধান হয় না। পুনরায় ঘটে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে যদি তা প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কাজটি যথাযথভাবে পালন করা হয়; তাহলে চার মাস পরই পুনরায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার সংবাদ শুনতে হলো কেন দেশবাসীকে? একই ধরনের দুর্ঘটনা পুনরাবৃত্তি কীসের বার্তা দেয় দেশবাসীকে! প্রতিটি দুর্ঘটনার পর নিয়মানুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং বহু ক্ষেত্রেই তদন্ত হয় নামকাওয়াস্তে। অনেক ক্ষেত্রেই তদন্ত রিপোর্ট হিমঘরেই পড়ে থাকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত আড়াই বছরে রেল দুর্ঘটনায় (নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-গাজীপুর) নিহত আট শতাধিক। আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেছেন আরো ছয় শতাধিক। শুধু রেলওয়ে পুলিশের হিসাবমতে, মৃত্যুর সংখ্যা ৭০০। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কমলাপুর থানা সূত্রমতে, ২০১৫ সালে রেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৯২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৮ ও নারী ৪৪ জন। অপমৃত্যু (ইউডি) মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা ২৮৫টি। ২০১৬ সাল রেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ৩০৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৪ ও নারী ৬১ জন। ইউডি মামলাসহ মোট মামলা ৩০৫টি। গত বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছে ১০৩ জন। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৫, মার্চে ২৩ ও এপ্রিলে ২২ জন মারা যায়।

অরক্ষিত লেভেলক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক, দায়িত্বরতদের অবহেলা, নানা যান্ত্রিক ত্রুটিবিচ্যুতি এবং সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেলে দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর অব্যবস্থাপনাও কম দায়ী না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনায় শোক জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনচালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং রেলসংশ্লিষ্টদের সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনাটি দ্রুতই বাস্তবায়ন হোক। অনেক সময় দেখা গেছে, চালকের অসতর্কতায় সিগন্যাল জটিলতায় দুর্ঘটনায় পড়ে ট্রেনে প্রাণ হারাচ্চেন যাত্রীরা। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে কর্মীদের দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি সব লাইনে ডিজিটাল সিগন্যাল চালুর করা অতীব জরুরি। রেলপথটি নিরাপদ করার জন্য ট্রেনচালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি। পাশাপাশি রেল দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে, দিতে হবে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার দায়িত্বও পালন করতে হবে সরকারকে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close