আবু আফজাল সালেহ

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৯

নিবন্ধ

বেড়েই চলেছে ট্রেন দুর্ঘটনা

ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনা হচ্ছে। এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মুখোমুখি ট্রেন দুর্ঘটনা, লাইনচ্যুত সংখ্যাও কম নয়। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মানুষ নিহত হয়। আহতদের সংখ্যাও কম নয়। নিহত-আহতদের অনেক পরিবার নষ্ট হয়। পথে বসে অনেক পরিবার। পুরোনো রেলপথ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা অন্যতম কারণ। জনবল সংকটও অন্যতম দায়ী। রেলপথ মেরামত বা পুনর্বাসন না করে নতুন নতুন ট্রেন চালু করাও কিন্তু কম দায়ী নয়। অতিরিক্ত লোড পড়ছে রেললাইনে। জনবল সংকটের কারণে যথেষ্ট বিশ্রাম পাচ্ছেন না রেল পরিচালনায় কর্মীরা। সিগন্যালের কর্মীরা অতিরিক্ত কাজের লোডে ক্লান্ত। এটাও ট্রেন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। বিরামপুরে রেললাইন অংশবিশেষ বিচ্ছিন্ন, ঈশ্বরদীতে ‘উল্টাপথে রেল চলা’ আমাদের জন্য বিপদসংকেত। ড্রাইভার ছাড়াও রেল চলে এ দেশে। ভাবা যায়!

১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত প্রায় ৫৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। মূলত ইংরেজরা এ দুই শহরের চিনিকল দুটোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে রেললাইন স্থাপন করে। ১৮৯১ সালে ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’ বাংলার পূর্বদিকে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আসামের চা রোপণকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত হয় রেললাইন। ১৯১২-১৫ সালে চালু হয় সিলেট রেলওয়ে স্টেশন। ব্রিটিশ আমলের নির্মিত লাইনে ভর করেই চলছে পূর্বাঞ্চলের রেলপথ। কখনো সেভাবে কোনো সংস্কার করা হয়নি। হয়তো দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু সংস্কার করা হয়। এখনো এ রুটের রেললাইনের অনেক জায়গায় সিøপারের নাটবল্টু নেই। যে কারণে দিন দিন ‘ভয়ংকর’ হয়ে উঠছে সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথ। দেশের পূর্বাঞ্চলে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি হলেও পশ্চিমাঞ্চলেও ইদানীং ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন আগে ঈশ্বরদীতে নতুন চালু ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’-এর বগিচ্যুত ও নষ্ট হতে দেখা গেছে। লালমনিরহাট সেকশনেও ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে।

জরাজীর্ণ লাইনে ঘটছে ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা। এ কারণে নিরাপদ রেলসেবার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মানুষের মনে। যাত্রীদের মনে তৈরি হয়েছে সংশয়। রেলপথ এত দিনে নিরাপদ হলেও ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এ সংশয়ের নেপথ্যে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা ট্রেন দুর্ঘটনা। গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের বরমচাল এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় চার যাত্রী নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু অতি সম্প্রতির ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে। ঊর্ধ্বমুখী ‘রেল উন্নয়ন’ ও ‘রেলসেবা’কে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কসবায় ১১ নভেম্বর রাতে উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথার দুর্ঘটনা রেলসেবা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তূর্ণার ড্রাইভার ও সহকারীকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে একাধিক তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছে। ঘটনাস্থলে ১০ এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর ছয়জনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছে ৭৪ জন। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের লুপলাইনের মুখে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথার মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনার জন্য তূর্ণা নিশীথার চালক (লোকোমাস্টার) তাসের উদ্দিন ও সহকারী অপুকে দায়ী করে বরখাস্ত করা হয়। আউটার ও হোম সিগন্যালে লালবাতি (সতর্কসংকেত) দেওয়া ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু তূর্ণা নিশীথার চালক সিগন্যাল অমান্য করে ঢুকে পড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ১৪ নভেম্বর ভুল পথে গিয়ে উল্লাপাড়ায় ‘রংপর এক্স’-এর ৭ বগি লাইনচ্যুত ও আগুন ধরে যাওয়ায় আরো ভাবিয়ে তুলছে।

বিভিন্ন পত্রিকাসূত্রে জানা যায় যে, গত ৪ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এর আগে গত ১৭ সেপ্টম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশনে জালালাবাদ ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুরে এবং তারও আগে গত ১৬ আগস্ট ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশনে ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। গত ১৯ জুলাই সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া জংশন রেলস্টেশনে ঢোকার সময় যাত্রীবাহী বগি লাইনচ্যুত হয়। পরদিন সকালে একই স্থানে গিয়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর কালনী এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। গত ২৩ জুন রাত ১০টায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশনে যাওয়ার আগে বরমচাল অতিক্রম করে মনছড়া রেলসেতুতে দুর্ঘটনায় ট্রেনের ছয় বগি লাইনচ্যুত হয়। একটি বগি সেতুর নিচে ও দুটি পার্শ্ববর্তী জমিতে উল্টে যায়। এতে চারজন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছে। গত ১৬ মে ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা সেতু পার হয়ে মল্লিকপুর এলাকায় লাইনচ্যুত হয় ট্রেনটি। ৫ এপ্রিল বেলা আড়াইটায় সিলেট-মাইজগাঁও রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী মোগলাবাজার এলাকায় কুশিয়ায়া এক্সপ্রেস লোকাল ট্রেনটিতে ইঞ্জিন থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় চালক ট্রেনটি টেনে মোগলাবাজার রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যান। ট্রেনের ইঞ্জিন গরম হয়ে হঠাৎ করে আগুন লাগার ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। এদিন রাত পৌনে ১১টার দিক মাইজগাঁও স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় শাহজালাল সার-কারখানা থেকে সার বহনকারী বিসি ¯েপশাল ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় ব্যাহত হয় যোগাযোগব্যবস্থা। গত ৯ মার্চ ফেঞ্চুগঞ্জে অল্পের জন্য বেঁচে যায় জয়ন্তিকা ট্রেনের যাত্রীরা। ট্রেনটি ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা রেলসেতুর পাশেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। এদিন কুশিয়ারা রেলসেতুর দক্ষিণে রেললাইন এক ফুট জায়গা ভেঙে যায়। তাৎক্ষণিক রেল যোগাযোগ বন্ধ করা না হলে ভয়ানক কিছু ঘটতে পারত। এসব ক্ষেত্রে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সবক্ষেত্রেই স্বাভাবিক রেল চলাচল বিঘিœত হয়েছে। সিলেট অঞ্চলে রেল লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব এলাকার জরাজীর্ণ রেললাইন মেরামত ও পুনর্বাসনে অধিক লক্ষ্য দিতেই হবে।

কমলাপুর-জয়দেবপুর সেকশনে ট্রেনের লোড অনেক বেশি। এ রুটে দেশের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের অনেক ট্রেন চলাচল করে। আবার ঢাকাকেন্দ্রিক অনেক নতুন ট্রেন চালু করেছে বর্তমান সরকার। এসব চাপও পড়ছে এ রেল সেকশনে। নতুন নতুন ট্রেন চালু করার আগে জরাজীর্ণ রেললাইন মেরামত করা দরকার। সিগন্যালিং উন্নতি হয়েছে। তবে আরো উন্নয়ন দরকার এ ক্ষেত্রে। জনবল সংকট দূর করতে না পারলে নতুন নতুন ট্রেন চালু করে বেশি লাভ হবে বলে মনে হয় না। এসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে নতুন নতুন ট্রেন যুক্ত না করে পুরাতন ট্রেনে বগি পরিবর্তন ও সংযোগ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কম ট্রেনে তুলনামূলক বেশি যাত্রী আরামে যাতায়াত করতে পারবে। রেলের ইঞ্জিন সংকটও প্রবল। কিন্তু ইঞ্জিন কেনার বিষয়ে আমরা পিছিয়ে। ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনেও দুর্ঘটনা ঘটে। লম্বা জার্নিতে ইঞ্জিন পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লম্বা রুটের ট্রেনের ইঞ্জিন আধাঘণ্টাও রেস্ট না পেয়ে আবার ছুটতে হচ্ছে। উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের ঢাকামুখী ট্রেনগুলোতে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। রেকের সংখ্যা বাড়িয়ে রেকের রেস্ট হলেও ইঞ্জিন সংকটে ইঞ্জিনের বিশ্রাম হচ্ছে না। জার্নির পর ইঞ্জিন গরম থাকতে থাকতেই আবার ছুটতে বাধ্য হচ্ছে।

সব ক্ষেত্রেই তদন্ত টিম গঠন করা হয়। রিপোর্ট প্রকাশ পায় মাঝেমধ্যে। শাস্তি হয় খুব কম পরিমাণে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তি হয়ও না। রেলে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার উপস্থিতির জন্য কর্তৃপক্ষ শাস্তি প্রয়োগ করতে পারে না। একটি কারণ প্রবল জনবল সংকট। অন্য একটি কারণ হতে পারে রেল কর্মচারীদের সংগঠনের হাতে কর্তৃপক্ষ জিম্মি হয়ে পড়ে অনেক ক্ষেত্রে। সিলেট সেকশনে রেলপথ সংস্করণ বা পুনর্বাসনের কাজ আগে ধরতে হবে। চট্টগ্রাম বা ঢাকার আশপাশের অনেক রেলপথ জরাজীর্ণ। মেরামত করা দরকার। ডাবল লাইন স্থাপন করতে হবে। রেলকর্মীদের নিয়মিত ও যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদশের রেল-কারখানা তিনটি। এগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ছোট জিনিসপত্র আমদানি করতে অনেক সময় লাগে। খালাস হতে বা পরিবহনেও সময় লাগে। আমাদের চট্টগ্রাম-সৈয়দপুর-পার্বতীপুরের কারখানায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তীব্র জনবল সংকট রয়েছে। কারখানার মেশিনপত্র বা কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে। অনেকে ক্ষেত্রে চুরিও হচ্ছে বলে শোনা যায়। অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানরা অবসরে চলে যাচ্ছেন। কিছুদিন পর কারখানাগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close