ইসমাইল মাহমুদ

  ১৬ নভেম্বর, ২০১৯

পর্যালোচনা

নকলের দাপটে আসল সংকটে

প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে ভয়াবহ অগ্নি-দুর্ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগুনের ভয়াবহতা আর্থিক ক্ষতিকেও ছাপিয়ে যায় মানবিক বিপর্যয়। আগুন নেপথ্যের নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান ও অন্যতম একটি কারণ হলো, নকল ও নি¤œমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এখন আমাদের গলার কাঁটা তথা জানমাল ধ্বংসকারী একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে।

বাড়িঘর, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও অফিসে নি¤œমানের এবং মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের কারণে দেশে অতি সম্প্রতিই ঘটে গেছে বেশ কয়েকটি অগ্নি-দুর্ঘটনা। এতে হতাহতের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর বরগুনা জেলার পাথারঘাটায় বিদ্যুৎস্পৃৃষ্ট হয়ে আমজেদ আলী খায়েরের স্ত্রী হামিদা বেগম (৫০), তার ছেলে রাসেল (২৫) ও রাসেলের চাচা দেলোয়ার হোসেন খানের (৪৫) মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ১ নভেম্বর বিকালে দৈনিক প্রথম আলোর সহযোগী প্রকাশনা ‘কিশোর আলো’-এর অনুষ্ঠানে গিয়ে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইমুল আবরার (১৫) বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যায়। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও কারো না কারো বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। আর এসব ঘটনার জন্য বৈদ্যুতিক পণ্যের নি¤œমানকেই অনেকাংশে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাজারে এখন আসলের চেয়ে ভেজাল কিংবা নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি অনেকটা সহজলভ্য। এককথায় নকলের দাপটে আসল পণ্য আজ নির্বাসনে। নকল বৈদ্যুতিক পণ্যের কারখানা শনাক্ত করে তা বন্ধ ও বাজার থেকে নকল পণ্য দ্রুত প্রত্যাহার এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি রাজধানীর একাধিক স্থানে আগুন লাগার পর টাস্কফোর্স ও তদন্ত কমিটি গঠন করে বিভিন্ন দফতর ও মন্ত্রণালয়। এসব তদন্তে অগ্নি-দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কারণ হিসেবে উঠে আসে শর্টসার্কিটের বিষয়টি। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গত এক বছরে শুধু রাজধানীতেই ১৮০টি শর্টসার্কিটের ঘটনা ঘটেছে বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্র নিশ্চিত করেছে। গড়ে প্রতি মাসে শুধু রাজধানীতেই ঘটেছে ১৫টি করে শর্টসার্কিটের ঘটনা। টাস্কফোর্স ও তদন্ত কমিটি কর্তৃক তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দফতর গঠন করে বিভিন্ন দফতর ও মন্ত্রণালয়ে জমা হলেও দুর্ঘটনা হ্রাস ও শর্টসার্কিট রোধে তদন্তে যেসব বিষয়গুলো সুপারিশ করা হয়েছে; তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে দিন দিন বাড়ছে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি, বাড়ছে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি।

আমরা জানি, জীবনকে সহজ করতেই আবিষ্কার হয়েছে নানা ধরনের বৈদ্যুতিক পণ্য। এসব পণ্য ব্যবহার আমাদের সময় অনেকটা বাঁচিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া অনেকটা হ্রাস পাচ্ছে কায়িক শ্রমও। কিন্তু নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী এখন আমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পণ্যের গুণগত মান নিম্ন হওয়ায় প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। তাই এসব পণ্য ক্রয় ও ব্যবহারে আমাদের আরো বেশি করে সচেতন হতে হবে।

বর্তমানে বাজারে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। আসলে কি এসব সামগ্রী ওই কোম্পানির বা ব্র্যান্ডের নাকি নকল তৈরিকৃত পণ্য- এ নিয়ে ক্রেতাসাধারণ সন্দিহান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতেই রয়েছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান, যারা নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরি করছে। নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা রয়েছে পুরান ঢাকার বংশাল, নবাবপুর, সিদ্দিক বাজার এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন তথ্য জনমানুষকে চমকে দিচ্ছে। নিত্যনতুন মোড়কে দামি ব্র্যান্ডের লোগো নকল করে বাজারজাত হচ্ছে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম- এমন অভিযোগও রয়েছে।

র‌্যাব রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক কেবল (তার) ও সরঞ্জামাদি উদ্ধার করেছে। র‌্যাবের অভিযানে ধরা পড়েছে দেশীয় ব্র্যান্ড বিআরবি, পলি কেবল, প্যারাডাইজ, ইস্টার্ন কেবল, বিবিএসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পণ্য নকল করছে- এমন কিছু বেনামি কারখানা।

চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি র‌্যাব রাজধানীর বংশালের সিদ্দিক বাজার ও আলু বাজার এলাকায় পাঁচটি কারখানা ও চারটি গোডাউনে অভিযান চালায়। এসব কারখানা ও গোডাউন থেকে জব্দ করা হয় ৪ কোটি টাকা মূল্যের নকল বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জামাদি। পরে সে কারখানা ও গোডাউনগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়। কারখানা ও গোডাউনে কর্মরত ১৮ কর্মীকে দুই বছর করে কারাদন্ড দেন র‌্যাব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত।

গত ১১ এপ্রিল রাজধানীর নবাবপুর এলাকায় নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক কেবল তৈরি, মজুদ ও বাজারজাত করার অপরাধে সাতজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড এবং ১৪ লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় জব্দ করা হয় ২ কোটি টাকা মূল্যের নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক কেবল (তার)।

১৬ এপ্রিল রাজধানীর নবাবপুর এলাকায় নকল ও নিম্নমানের তার তৈরির কারখানার সন্ধান পায় র‌্যাব। ওই সময় পরিচালিত অভিযানে ১০টি গোডাউন সিলগালা, ৪ কোটি টাকার মালামাল জব্দ, ১০ জনকে ৩২ লাখ টাকা জরিমানা এবং দুজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন অগ্নি-দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে নি¤œমানের কেবলের (তার) ব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে সামান্য শর্টসার্কিট থেকে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। শুধু বৈদ্যুতিক কেবলই নয়, অগ্নিঝুঁকি রোধকারী সার্কিট ব্রেকারও তৈরি হচ্ছে অননুমোদিত কারখানায়। যেগুলোর কোনোই মান নেই। শর্টসার্কিট ঠেকানো তো সুদূরপরাহত।

দেশে বর্তমানে নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক পণ্যের উৎপাদন এবং ব্যবহার বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হলোÑ এগুলো দেখার কি কেউ নেই? এগুলো দেখা যাদের কাজ তারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে? অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে যেসব ভুঁইফোড়, বেনামি প্রতিষ্ঠান নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরি করছে, প্রতারিত করছে ভোক্তাদের এবং বাড়িয়ে দিচ্ছে অগ্নিঝুঁকির সম্ভাবনা, এদের নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। নতুবা অগ্নি-দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি ক্রমেই বাড়তে থাকবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close