অলোক আচার্য

  ১৬ নভেম্বর, ২০১৯

নিবন্ধ

সুখ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবনিকাশ

সুখ কী? সুখের অনুভূতির স্থায়িত্ব! কেন প্রতিটি মুহূর্ত মানুষ সুখের খোঁজে ছুটে চলেছে? এসব প্রশ্নের কোনো ধরাবাধা উত্তর নেই। কারণ সুখেরও যেকোনো ধরাবাধা নিয়মনীতি নেই। নেই কোনো নির্ধারিত মানদন্ড। জীবনের কোন পর্যায়ে ব্যক্তি সুখী আর কোন পর্যায়ে অসুখী; তা নির্ধারণ করার নিয়ামক কেবল ব্যক্তি নিজেই। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কে সুখী আর কে অসুখী। সুখের খোঁজে ছুটতে ছুটতে মানুষ সুখের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। যার নেই কোনো চিকিৎসা। কেউ চলেছে উদরপূর্তির সুখের খোঁজে, কেউ গাড়ি-বাড়ির মালিকানার মাঝে সুখের সন্ধানে, কেউ প্রিয়জন খোঁজার ভেতরে সুখের সন্ধান পেতে, আবার পোশাকের ভেতরে অথবা ফ্যাশনের বাহ্যিক চাকচিক্যের মাঝে সুখ খুঁজতেও দেখা যায় অনেককে। বহু সুখের সন্ধান পেতে মানুষের এত ব্যস্ততা। এত খুঁজেও কী আমরা পেরেছি, সুখকে করতলগত করতে! না আরো বেশি অসুখী হয়ে পড়েছি? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজারও সময় নেই। তার আগেই যে আবার তাকে ছুটতে হচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি করছে কেবল সুখে থাকার আশায় মানবজাতির এ ম্যারাথন। এত একাগ্র চাওয়াও মানুষের অসুখের বেড়াজাল ভেদ করতে পারে না। কেবল পাওয়ার মধ্যে সুখের অবস্থান, এ কথাকে চিরন্তন সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না। হারানোর মাঝেও সুখ আছে। স্বামী স্ত্রীকে ছেড়ে যায় আবার স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে যায়, তাও কেবল সুখের খোঁজে! কী আশ্চর্য সুখানুভূতি! অন্যের তাতে দুঃখ পেলেও কিছু যায় আসে না।

মেকি সুখের জন্য ব্যস্ত সমাজের সবার আজ দম ফেলার সময় পর্যন্ত নেই। যে কর্মচারীটি অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়েন, বাড়ি-গাড়ি করেছেন, সেও কিন্তু কেবল সুখের আশায়। সুখ পেয়েও সে থেমে যান কি? থামেন না। বরং সুখপ্রাপ্তির নেশা তার দ্বিগুণ হয়। এত কিছু দেখে সুখ নিয়ে সেই ছোটবেলায় পড়া, সেই বিখ্যাত কবিতার কথা মনে হয়। ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ জীবন মন সকলি দাও/তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?/আপনার কথা ভুলে যাও। সত্যিকারের সুখ নিজের স্বার্থের ভেতর নয়, বরং অপরের ভেতর নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে। এই সহজ সুখ লাভের সূত্রটি আমরা প্রায় সবাই জানলেও কেউ বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করি না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ততাতেই সুখ মনে করি। প্রকৃতপক্ষে সুখ হলো, অতি অল্প সময়ের আনন্দপূর্ণ এক অনুভূতি। ব্যক্তিবিশেষে এই অনুভূতি ভিন্ন হয়ে থাকে। অনেক সময় এটি সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থার ওপরও নির্ভর করে। কেউ কোটি টাকা পেয়েও সুখী হতে পারেন না আবার কেউ তিন বেলা পোলাও-কোরমা খেতে খেতে অসুখী। ফলে এ ধরনের ব্যক্তি কিসে সুখী হবেন, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কেবল তার। বিপরীতে অনেকে জীবনে নানা সংকটের মুখোমুখি হওয়ার পরও নিজেকে সুখী মনে করেন। এটাই সুখের পরস্পর বিপরীত চিত্র। যে মানুষটি সারা দিন ভাত পান না, সন্ধ্যার সময় তিনি যে পেটপুরে ভাত পেলেই সুখী হবেন, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এই সুখ কেউ অনেক অনেক টাকা দিয়েও কিনতে পারবেন না। কারণ অনুভূতির ভিন্নতায় সুখের অনুভূতিতেও তারতম্য ঘটে। ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধাপূর্ণ হওয়ার তৃপ্তি আর ক্ষুধাপূর্ণ মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তির অনুভূতি এক হয় না। ভিন্নতা ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য।

মনের গহিনে সুখের যে বীজ সুপ্ত অবস্থায় থাকে অনেকে তার খোঁজ সারা জীবনেও পান না। সুখ নিয়ে সাহিত্যিকরাও কত কিছু উপহার দিয়েছেন। কত গল্প, কবিতা লেখা হয়েছে সুখ নিয়ে। আমরা সুখ নিয়ে একটি গল্প প্রায় সবাই জানি। রাজার অসুখ নিয়ে লেখা সেই গল্প আমাদের সুখের অনুভূতি এবং আমাদের দৃশ্যমান সুখানুভূতি স্মরণ করিয়ে দেয়। গল্পে সুখের অসুখই ছিল রাজার প্রধান অসুখ। সবাই যখন রাজাকে রোগমুক্তি করতে নানা চিকিৎসাপত্র নিয়ে ব্যস্ত এবং কোনো ওষুধেই কোনো কাজ হচ্ছে না, তখন একজন জানালেন রাজার গায়ে কোনো সুখী মানুষের কাপড় জড়িয়ে দিতে। তাহলেই রাজার অসুখ সেরে যাবে। তারপরই বাধে বিপত্তি। প্রথমে কাজটিকে যত সহজ মনে করা হচ্ছিল আদতে কাজটি ছিল ততটাই কঠিন, এটা রাজার লোকজন বুঝতে পারল। যাকে বাইরে থেকে দেখে সুখী মনে হয়, সে আসলে সুখী না। শেষমেশ সুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া গেলেও তার কাছ থেকে নেওয়ার মতো কোনো কাপড় ছিল না।

অত্যন্ত চমৎকার করে সুখের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। সুখের চিরায়ত সংজ্ঞাই এই গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভোগবাদ যে প্রকৃত সুখ আনতে পারে না, তা গল্পের মাধ্যমে বুঝতে পারি। কিন্তু আমরা সবাই সেদিকেই ছুটছি অবিরত। বস্তুবাদকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সুখের চিরায়ত সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়েছি। সবকিছু পাওয়ার চেষ্টা করছি অথচ যখন অনেক কিছু পেয়ে যাচ্ছি, তখন মনে হচ্ছে কিছুই পাইনি। এই অতৃপ্তি আবার কোনো কিছু পাওয়ার জন্য ধাবিত করছে। সুখের খোঁজে বেরিয়ে অতৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরছি। একই অবস্থা প্রতিনিয়তই আমাদের সঙ্গে ঘটে চলেছে। আমাদের আধুনিক সমাজের সুখ খুঁজতে ব্যস্ত টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, দালানকোঠা, বিত্তবৈভবের মাঝে।

দিনভর এসিঘেরা গাড়িতে চড়ে রাত হলেই আধুনিক বারে-মদের গ্লাসে সুখ খোঁজে ফেরে আধুনিক সমাজের সিল দেওয়া বহু মানুষ। সুখের জন্য চাই প্রচুর অর্থ। নিজের সুখ, সন্তানের সুখ, প্রিয়তমা স্ত্রীর সুখ, সামাজিক সম্মান, বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক-ব্যালান্স এবং এসব জোগাতে গিয়ে দুই হাত পেতে ঘুষ নেওয়া, মাদক-জুয়ার আসরে দৌড়াদৌড়ি করার মাধ্যমে কালোটাকার পাহাড় তৈরি। তারপর এক দিন এই টাকার পাহাড়ের নিচেই চাপা পড়ে মুক্তির আর্তনাদ করা। এইতো নিয়তি! সুখের খোঁজ পেতে আদর্শ বিচ্যুত হয়ে অসুখের মাঝে পতিত হওয়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে। সে অসুখের না আছে কোনো প্রতিষেধক, না আছে চিকিৎসা। ত্যাগেই যে প্রকৃত সুখ, তা তো আজ আমাদের চেতনায় বিলীন হতে বসেছে। সুখ আর দুঃখের মাঝে যে পার্থক্য, তা সে বোঝে না। সুখ খুঁজতে গিয়েই মানুষ আজ হিংস্র হয় ঠিক পশুর মতো, মানুষকে মরতে হয়, ধর্ষিত হয় প্রতিদিন, তাও কি কেবলই সুখ পাওয়ার জন্য! এ সুখ বিকৃত মানুষের কুৎসিত মনের প্রতিচ্ছবি। সর্বত্রই এসব কুৎসিত মনের মানুষের চলাফেরা। তার সুখ খুঁজতে ব্যস্ত যে! এসব করতে গিয়ে সুখের কাছেই আমরা ঋণি হয়ে যাচ্ছি। বিচিত্র সব সুখের খোঁজে বিচিত্র মানুষের দল ছুটছে। দিন শেষে কে সুখ পেল আর কে বঞ্চিত হলো তার হিসাব রাখার জন্য কেউ নেই। যে হিসাব রাখবে, সেও হয়তো অসুখী। হয়তো দেখা যায়, সারা দিন রাস্তার পাশে পাথর ভাঙা সেই পেশিবহুল শ্রমিকটাই সুখী। তার কাটানো রাতটাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের কাটানো রাত হতে পারে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close