দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ১৫ নভেম্বর, ২০১৯

নিবন্ধ

কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পণ্যের অপচয় রোধ এবং সহজ বাজারজাত নিশ্চিতকরণে সমবায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বলেছেন, আমাদের চাষোপযোগী জমি সীমিত। তার পরও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। প্রায় সব খাদ্য উৎপাদনে আমরা অগ্রগামী। সমবায়ের ভিত্তিতে কাজ করতে পারলে অপচয় যেমন কম হবে, তেমনি বাজারজাতে সুবিধা পাওয়া যাবে, প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

দেশের কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সমবায়ের যোগসূত্র স্থাপন করা গেলে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে। চাষোপযোগী কোনো জমি অনাবাদি থাকবে না। সমবায়ের মূল চেতনা হলো সম্মিলিত উদ্যোগ। একার পক্ষে যে কাজ করা সম্ভব নয়, তা সম্মিলিত উদ্যোগে সহজে করা যায়। সমবায় অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশের কৃষি, মৎস্য চাষ, পশুপালন, দুগ্ধ উৎপাদন, পরিবহন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, আবাসন, পুঁজি গঠন ও নারীর ক্ষমতায়নে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার সমবায় সমিতি রয়েছে; যার সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৯ লাখ। এসব সমবায় সমিতির মোট কার্যকর মূলধনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। সমবায়ের মাধ্যমে সৃষ্ট কর্মসংস্থানের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। এ ক্ষেত্রে অজুত সম্ভাবনা বিরাজ করছে। বিশেষ করে দেশের ধান উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণে সমবায় পদ্ধতি কাজে লাগালে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে অবদান রাখবে। আলু-পেঁয়াজসহ আরো কিছু পণ্য সংরক্ষণে সমবায় পদ্ধতি কাজে লাগানো যেতে পারে। দেশে গত চার যুগে খাদ্য উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়লেও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার নানা সরকারি উদ্যোগ থাকলেও তাতে লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষি উৎপাদনে সমবায়ের ভিত্তিতে কৃষি উপকরণ সরবরাহ, উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ এবং বাজারজাতের ব্যবস্থা করলে তাতে সমবায় আন্দোলন যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি নিশ্চিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। এ ব্যাপারে কৃষকপর্যায়ে সমবায় সংগঠন প্রতিষ্ঠায় সরকার উৎসাহ জোগাবেÑ এমনটিই প্রত্যাশিত।

এদিকে বাংলাদেশ কৃষক লীগের দশম জাতীয় কাউন্সিলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও সবশেষ জোর দিয়ে বলেছেন, শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে কোনোক্রমেই কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। কেননা, কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অদ্যাবধি মূল চালিকাশক্তি। দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষকে দৈনন্দিন আহার ও পুষ্টি নিয়মিত জুগিয়ে যাচ্ছে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। সে অবস্থায় সর্বাগ্রে কৃষিজমির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প-কারখানা যদি স্থাপন করতেই হয়, তাহলে অগ্ররাধিকার দিতে হবে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে। সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি-অবকাঠামো ও যথাযথ রাস্তাঘাটসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সহজলভ্য। এরপরও যদি শিল্প স্থাপনের প্রয়োজন পড়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য, তাহলে তা অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অঞ্চলে, বড়জোর এক ফসলি জমিতে করা যেতে পারে। দেশের স্বার্থে এবং উন্নয়নের প্রয়োজনে শিল্পায়নে জোর দিতে হবে অবশ্যই। তবে তা কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নয়। বরং কৃষি ও কৃষককে যথাযথ সহায়তা দিয়েই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দেশের শিল্পায়ন ও অগ্রগতি। আর তাহলেই কেবল কৃষি ও কৃষক বাঁচবে। পাশাপাশি গড়ে উঠবে শিল্প-কারখানা, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। এর জন্য যুগোপযোগী করতে হবে কৃষি আইন ও ভূমি সংস্কার।

নতুন আইন তৈরির পাশাপাশি ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ভূমি সংক্রান্ত আইন ও বিধি সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষকে আরো গতিশীল ভূমিসেবা প্রদানই এর অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, দেশে ভূমি-সংক্রান্ত আইন, বিধি, জটিলতা, বেচাকেনা, রেজিস্ট্রেশন, নামজারি, খাজনা প্রদানে নানা সমস্যা-সংকট তদুপরি দেওয়ানি মামলার পাহাড় ও দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে প্রায় সর্বস্তরের মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। পাশাপাশি উৎকোচ প্রদান, ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তো আছেই। এসব অবসানের লক্ষ্যেই ভূমি আইন আধুনিক, সময়োপযোগী ও ডিজিটাল করা হচ্ছে।

১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে গ্রামাঞ্চলে ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতির বিধান থাকলেও সেটি প্রতিপালিত হয় না কোথাও। ফলে কৃষিজমিসহ ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার এমনকি অপব্যবহার বেড়েছে ক্রমেই। যে যেখানে খুশি মর্জিমাফিক গড়ে তুলেছে বসতবাড়ি কিংবা অন্যবিধ স্থাপনা। বাগানবাড়ি, পার্ক এমনকি শিল্প-কারখানা। ফলে দিন দিন ভূমি বিশেষ করে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। অনেক স্থানে এমনও দেখা যায় যে, ধানের জমির মাঝখানে অথবা জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন বাড়িঘর। অনেক ক্ষেত্রে নদ-নদীসহ অবৈধ দখলের অভিযোগও আছে। বেদখলে বনভূমিও উজাড় হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন কৃষিজমির পরিমাণ কমছে, অন্যদিকে ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাশয়, লোপাট হচ্ছে খাসজমি ও বনভূমি।

বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে এবং শহর-বন্দরসহ নানা স্থানে শিল্প-কারখানাসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। তবে এসবের অধিকাংশই অপরিকল্পিত, ভূমির ব্যবহার যথেচ্ছ এবং কোথাওবা অবৈধ। খাসজমি এমনকি জলাশয়, নদ-নদী দখল করেও চলছে নির্মাণ পর্বের দক্ষযজ্ঞ। ভূমির পরিমাণ যেহেতু সীমাবদ্ধ ও সীমিত, সেহেতু তা অবশ্যই পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহারের দাবি রাখে। সেটাও হতে হবে সুষ্ঠু, সমন্বিত, সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব। নতুন ভূমি আইনে তা নিশ্চিত করা গেলে একদিকে যেমন জমির অপরিকল্পিত ব্যবহার রোধ হবে; অন্যদিকে সুনিশ্চিত হবে উন্নয়নের গতি। অব্যাহত থাকবে খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা। অনলাইনে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে জমির খাজনা, নামজারিসহ রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা সম্পন্ন করা গেলে এসব প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত সহজে হয়রানি ব্যতিরেকে জনসেবা দিতে পারবে। পাশাপাশি কমবে কৃষকের অযথা হয়রানি, সময়ক্ষেপণ ও দুর্নীতি।

লেখক : সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close