ইসমাইল মাহমুদ

  ১৫ নভেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

যুবলীগের সংগ্রামী পথচলার ৪৭ বছর

বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত এ দেশটি শত্রুমুক্ত হওয়ার পর থেকেই নতুন করে শুরু হয় ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। পরাজিত পাক হায়েনাদের এ দেশীয় এজেন্টরা নতুন করে তৎপর হয়ে ওঠে। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতর শত্রুরা তখনো হাল ছেড়ে দেয়নি! একটি কথা সর্বত্র প্রচারিত তা হলো ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। এই কঠিন কাজটি আমাদের জাতির জনক, ইতিহাসের মহানায়ক, বিশ^রাজনীতির রোল মডেল, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের কাঁধে তুলে নেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতের ছায়ায় দেশটির ভাগ্যাকাশে সাফল্যের লাল সুর্য উদিত হতে থাকে। তবে এ সময়ে দেশের মানুষের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তনের জন্য এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে প্রয়োজন হয় পরীক্ষিত সৈনিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পাই, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ। তাদের নেতৃত্বে দেশের যুবসমাজ পাক হায়েনাদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সাবেক ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান ছাত্র ও যুবশক্তির বড় একটি অংশকে আওয়ামী রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করার হীন উদ্দেশ্যে গোপন একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর সিরাজুল আলম খান ক্ষমতা দখলের হীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে ভিন্ন মতাদর্শে এ দেশের কিছুসংখ্যক যুবসমাজকে সংগঠিত করেন। এরই অংশ হিসেবে সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ‘জাসদ’ নামের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ হয়। শুরুতে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে যুব সংগঠন করার চিন্তা-ভাবনা থাকলেও সিরাজুল আলম খানের ফর্মুলায় পরবর্তীতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ‘জাসদ’ গঠন করে দেশের যুবসমাজের একটা অংশকে আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রম শুরু হয়।

একদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুচারু ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ চলছে; অন্যদিকে জাসদ সারা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির তৎপরতা অব্যাহত রাখে। সদ্য স্বাধীন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যখন এমনি ঘোলাটে অবস্থায়; তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী তরুণ ও যুবসমাজের বিভ্রান্তি দূর করতে এবং যুবসমাজ যেন হতাশাগ্রস্ত হয়ে না পড়ে; সে লক্ষ্যে দেশে পরিশীলিত মুক্তচিন্তার একটি যুব সংগঠন তৈরি আবশ্যকতা প্রতীয়মান হয়। এ অবস্থায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক, দেশখ্যাত সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি স্বচ্ছ রাজনৈতিক কর্মপরিধিতে যুবসমাজের অংশগ্রহণের ব্রত নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর দেশের প্রথম যুব সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত ও মুজিব ভাবাদর্শের সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ আন্দোলন-সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে বর্তমানে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ যুব সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। যুবলীগ আজ বিশে^র সব দেশের যুবসমাজের জন্য একটি ‘আইডল’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মনি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যুবলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলের নেতাকর্মীরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নিজেদের পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগের পাশাপাশি অপশক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে যুবলীগের নেতাকর্মীরা বারবারই নিজেদের জীবন-যৌবন বিলিয়ে দিয়েছেন। বারবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যুবলীগের নেতাকর্মীরা রাজপথে ঢেলে দিয়েছেন বুকের তাজা রক্ত। প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বর্ষ পালনের আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সমূলে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। জাতির জনকের হত্যার প্রতিবাদে সর্বপ্রথম আন্দোলন শুরু করেন যুবলীগ নেতাকর্মীরা। আন্দোলন করার অপরাধে বগুড়ায় যুবলীগ নেতা আব্দুল খালেক খসরু, চট্টগ্রামে যুবলীগ নেতা মৌলভী ছৈয়দ আহমদ নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচার এরশাদের শাসন-নির্যাতনে অতিষ্ঠ দেশের মানুষকে মুক্ত করার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যুবলীগের নেতাকর্মীরা। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুবলীগ নেতা নূর হোসেনের বুকের তাজা রক্তে লাল হয় রাজপথ। তার আত্মত্যাগের পর আন্দোলন আরো তীব্র ও বেগবান হয় এবং ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন স্বৈরশাসক এরশাদ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনি মোশতাক, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলে ক্ষমতার দম্ভে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। দীর্ঘ ২১ বছর দলটির নেতাকর্মীরা অমানুষিক ত্যাগ স্বীকার করে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছায়াসঙ্গী হিসেবে থেকে যুবলীগ নেতাকর্মীরা জাতির জনকের রক্তের ঋণ শোধে মাঠে-ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। প্রায় ২১ বছরে সারা দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে যুবলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সঠিক নেতৃত্বের হাতে দেশের মানুষের সেবার দায়িত্ব তুলে দিতে ওই নির্বাচনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে যুবলীগ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদদ ও সহযোগিতায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, সারা দেশের সাধারণ মানুষের প্রাণভোমরা, জাতির জনকের সুযোগ্যকন্যা, দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এর প্রতিবাদে সারা দেশে মাঠে-ময়দানে যুবলীগ ছিল সোচ্চার ও অপ্রতিরোধ্য। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী যুবলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১/১১-এর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আটক করে। তার মুক্তির আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যুবলীগ। এ কারণে সারা দেশে গ্রেফতার হয়ে নির্যাতনের শিকার হন শত-সহস্র যুবলীগ নেতাকর্মী। অপ্রতিরোধ্য যুবলীগের নেতাকর্মীদের দৃঢ়তায় এবং আওয়ামী লীগের সহযোতিায় সেসময় আন্দোলন-সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হয়; যার কারণে সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালে দেশে ভোট বিপ্লবের নেপথ্যে অন্যতম অবদান ছিল আওয়ামী যুবলীগের। এ ছাড়া যুদ্ধপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের বিচারকার্য স¤পন্ন এবং ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে হেফাজতের ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ সরকারের ছায়াসঙ্গী হিসেবেও যুবলীগ রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর দেশের প্রথম যুব সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৪৭ বছরে ছয়টি কংগ্রেস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মনি চেয়ারম্যান ও অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমদ সাধারণ স¤পাদক নির্বাচিত হন। চলতি বছরের ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নানা কারণে যুবলীগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরীকে তার পদ থেকে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে।

আওয়ামী পরিবারের সর্বোচ্চ অভিভাবক শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী আগামী ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে আরো সমৃদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাবে মুজিব আদর্শের প্রিয় যুব সংগঠন যুবলীগÑ এমন প্রত্যাশা করছে সারা দেশের যুবসমাজ। গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাÑ এই চার মূলনীতিকে সামনে রেখে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, যুবসমাজের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী যুবলীগ এখন বদ্ধপরিকর।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close