সাঈদ চৌধুরী

  ১২ নভেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

আর্জি চলে যাচ্ছে মর্জির বিবরে

আমাদের যুদ্ধগুলো কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে! আমরা এখন একটি সুন্দর ছবি তোলার জন্য যুদ্ধ করি। একজনের যদি একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা থাকে তার দিকে এমনিতেই হেলে পড়ে একটি গ্রুপের মানুষ। সবাই তার সঙ্গে খাতির করে ছবি তুলে নিতে চায়। একটা সুন্দর ছবি হলেই যেন সব পাওয়া হয়ে গেল! হ্যাঁ নিজেকে দেখতে তো ভালো লাগতেই হবে, কিন্তু নিজের কর্মটাও তো হওয়া প্রয়োজন তেমনই। আবার একটি মাছ সবার পছন্দ হলেও ক্রেতা তো একজনই হবে। সেখানেই বেশি দাম দিয়ে হলেও কিনতে হবে মাছÑ এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়! প্রতিযোগিতাগুলো এমন জায়গায় হচ্ছে, তা কিন্তু সবগুলোই প্রদর্শন করার জন্য। আমাদের ফিকে হয়ে যাওয়া মানবতাকে প্রকাশের এত বেশি প্রতিযোগিতা যে, আমরা ভুলেই গেছি সঙ্গে চলা, একসঙ্গে হয়ে একটু আনন্দ নেওয়া, গল্প করা, একজন আরেকজনের দিকে গোপনে তাকিয়ে ভালোবাসার স্বাদ নেওয়ার মতো সতেজ স্বাদগুলো!

যেখানে দিন দিন আমরা ওষুধ উৎপাদনে বিশ্বে ক্রিয়াশীল হয়ে নিজেদের চেনাচ্ছি; সেখানে আমাদের এমন কিছু রোগ বাড়ছে তার কোনো ওষুধ বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। যদি বলা হয়, আগামী বিশ্ব কোন রোগের কারণে বিলুপ্ত হতে পারে; তাহলে আপনি নিশ্চিত ধরে নিতে পারেন এমন রোগ আমাদের সামনে আসছে; যা আত্মাঘটিত, বায়বীয় এবং যা ছড়াতে থাকলে আর কোনোভাবেই তা বন্ধ করার কৌশল বা ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।

একটু দেখুন খেয়াল করে যখন আপনি ডিএসএলআর এ ছবি তোলায় ব্যস্ত; তখন আপনার উদ্দেশ্য শুধুই একটু সুন্দর ছবি দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা। অবাক হওয়ার মতো বিষয় অপরাধীদেরও সুন্দর সুন্দর ছবি আছে। তারা সবাই নিজেকে আবৃত করে রাখে এই ছবিগুলো দিয়েই! অথচ একটি ছবি আর একজন সাদা মনের মানুষের দূরত্ব মাপলে যেটা বের হবে, তা সত্যিই অনেক বেশি হতাশার ।

যারা ভালো কথা বলছেন, তারা ভালোর মধ্যেই ভালো কথাগুলো বলছেন! খারাপরা সারা দিন ধরে খারাপ কথাই অনুশীলন করছেন। তারা উপাসনালয়েও যান না! তবে এ রোগগুলোর ওষুধ কোথায় পাব আমরা? আমাদের একটি জায়গায় অসহায়ত্ব তৈরি হচ্ছে আর তা হলো আমরা শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি তৈরি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি! বাবার কাছে ছেলে এখন আর্জি নিয়ে যায় না; যায় মর্জির ভয়াবহ একটা রূপ নিয়ে। অনেক সন্তান বলে আমাকে এটা কিনে না দিলে আমি আত্মহত্যা করব অথচ এই ছেলের ফেসবুক আইডি, সামাজিক চলাচল ঘেঁটে দেখুন, সে কতটা স্ট্যান্ডার্ডভাবে জীবনযাপন করে!

আঙুল ফুলে কলাগাছের প্রবাদ বাক্য আমরা একটা সময় পড়তাম আর এখন যা পড়তে পারি না তা হলো মনের মধ্যে উলুর বাস! উলুর কথাটি এ কারণে বললাম যে, উলুর ঘরটা খুব ভঙ্গুর আর নমনীয়। আমরা যে ঘর বানাচ্ছি, তা যে উলুর ঘরের মতোই তা স্পষ্টই দেখা যায়, এখনকার মানুষের বৈশিষ্ট্যে ! বাবা নিজে চুবিয়ে মেরে ফেলেছে তার সন্তানকে। শ্রীপুরে এমন একটি ঘটনার খবর গত কয়েক দিন আগে সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। ১৮ দিনের ফুটফুটে একটি সন্তান! অভিযোগ এসেছে, বাবা পরকীয়া করত, নেশা করত আর বউকে মারত! তিনটি বিষয় এখানে অপরাধের। অথচ দেখুন ওষুধ নেই। এটা তো অসুখ তাই না ! যদি অসুখই হবে এর ওষুধ কী?

নৈতিকতা শিক্ষার কথা বলবেন তার দায়িত্ব কে নেবে আর কেনইবা আপনার কথা মানুষ শুনবে? এক দিন এক অটোচালককে বলেছিলাম, আপনি অটো চালান কিন্তু চালনার ব্যাপারে কোনো আইন জানেন? সে আমাকে উত্তর দিয়েছিল, এত ছোট গাড়ির চালকের নাকি আইন জানার দরকার নেই! যদি বলেন, আমারই আইন শেখানোর দরকার ছিল, তবে একটি প্রশ্নÑ সে কি আমার কাছ থেকে আইন শিখতে বাধ্য, নাকি আমি তাকে বাধ্য করব আর বাধ্য করলেই কী শিখবে আমার কাছ থেকে সে? এই অটোচালকেরও একটি ফেসবুক আইডিতে দেখেছি ডিএসএলআর তোলা একটি সুন্দর ছবি! প্রতিযোগিতা করে ছবি তুলতে পারি, কিন্তু হাত ধোয়া শেখানোর জন্য আমাদের পেছনে ব্যয় করে এমন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে!

যে শিশুটিকে তার বাবা মেরে ফেলল এই শিশুটির কী কী অধিকার ছিল, দেখুন তো তার অবলা মুখে আপনি দেখতে পান কি না ? সে বলছে, আমি বাবার কনুইয়ের ওপর মাথা রেখে নিরাপত্তার চাদরে ঘুমিয়ে পড়তে চাই, মায়ের আঁচলতলে সামান্য ভালোবাসার পরম আদর চাই আর চাই সুন্দর দেশে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠতে! আসলে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি বায়বীয় প্রেতাত্মা বহনকারী কোন রোগে! একটি শিশুর অভিশাপ আরেকটি ঘর বিনাশ করে দিচ্ছে। আর আমরা মেনে নিতে নিতে এমন হয়ে গেছি নিজের ঘরে আগুনের লেলিহান শিখা না দেখা পর্যন্ত নড়ে ওঠে বলি না, এই পানি দে আগুন ধরেছে ! আমাদের একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কি শুধু বিচার চাই, বিচার চাই বলব; নাকি আমরা বলব বাঁচতে চাই বাঁচতে চাই?

যদি বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই, বলতে চাই; তবে আর অপেক্ষা নয়, এমন একটি কাঠামো দাঁড় করতে হবে, যা পুরো সামাজিক চিন্তাকেই ঢেলে সাজানোর মতো খুঁটি থাকে! আসুন একে একে বলতে শুরু করি, আমরা একটু কোমলভাবে ভাবে বাঁচতে চাই। এমন কিছু প্রতিযোগিতা চাই, যাতে শুধু দেখানোর আলগা ভাব না থাকে, যাতে অসুস্থতা না থাকে, যাতে না থাকে অস্থিরতা। সবুজ পৃথিবীর আন্দোলনে যারা আছে, যারা বলে বেড়ায় সুন্দর একটি বাসভূমি চাই। আসুন কথাগুলো উচ্চৈঃস্বরে বলি আর প্রতিধ্বনি তুলে ঢুকিয়ে দেই পাপী আত্মাগুলোর রোবটীয় অস্তিত্বে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close