রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১২ নভেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

ছাত্র-শিক্ষক অপরাজনীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ

যে শিক্ষা ব্যক্তিজীবনে চিত্তকে ঐশ্বর্যশালী করে গড়ে তোলে, যার সুনিপুণ ছোঁয়ায় পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বয়ে চলে প্রশান্তির ফল্গুধারা, তা আজ শিক্ষালয়গুলো হতে ক্রমেই তিরোহিত হতে চলছে। জ্ঞানের প্রখরতার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রেখে যে শিক্ষার্থী জ্ঞান বিতরণের ব্রতী হয়েছিল; সেই আজ অর্থের দমকা হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের ওই প্রাগুক্ত কাজকে হেয় জ্ঞান করছে। সোনার খাঁচায় ব›িী আহত পাখিটি পর্যাপ্ত আহার পাওয়া সত্ত্বেও মুক্ত আকাশে ওড়ার স্বপ্নে অনুক্ষণ ছটফটিয়ে বেড়ায়, রুচিশীল ভৃত্যটি আজ ভালোবাসাহীন মনিবের সঙ্গ পরিত্যাগে ব্রতী হয়ে উঠেছে। আঁধার নামল বলে মাঠের গরুটি খুঁটি উপড়ে বাড়ি ফেরার নেশায় মেতেছে। মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে বলে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা সবাই আজ প্রত্যয়ী কণ্ঠে সংগ্রামের শপথ নিয়েছে। অথচ আমাদের শিক্ষা সংকটে আরোহী যাত্রীদের চেতনার নীল আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। আমাদের দেশের একজন শিক্ষার্থীকে মোটামুটি ১৭ থেকে ১৮ বছর কাটাতে হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেছনে অর্থাৎ জীবনের একটি বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটায়। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক সবলতার পাশাপাশি মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করে একজন শিক্ষার্থীকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সম্প্রতি শিক্ষক রাজনীতি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, শিক্ষকরা কেন রাজনীতি করবেন। শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির কারণে ছাত্ররা আজ তাদের সম্মান দেন না। ভিসি, প্রো-ভিসি হওয়ার জন্য শিক্ষকরা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।

দেশের ক্রান্তিকালে মেধাবী সন্তানদের পাশে না পাওয়ার আশঙ্কা তাদের মনে। একদল ছাত্ররাজনীতির ঘোরবিরোধী। তাদের যুক্তির অভাব নেই। তাদের মতে, ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির কারণে লেখাপড়া শিকেতে উঠেছে। রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে, নীতির আলোকে জনগণকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা। তাদের মতে, যে রাজনীতি করার কারণে নীতি বর্জন করতে হচ্ছে, সেই রাজনীতি করার কী দরকার! এরা যুক্তি দিয়ে বলেন, স্বাধীনতার পরে ছাত্ররাজনীতির ভালো তেমন কোনো উদাহরণ নেই; অথচ খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি উদাহরণ টানলে কয়েকটি সাহিত্য রচনা করা যাবে। এদের কথা, ক্যাম্পাসে আসছেন লেখাপড়া করার জন্য। লেখাপড়া করো, নীতি-নৈতিকতা শেখো, রাজনীতি করতে চাইলে পাস করার পড়ে ভোটে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করো। উদাহরণস্বরূপ জাস্টিন ট্রুডো, অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, বারাক ওবামা এদেরকে আনা হচ্ছে; প্রশ্ন ছুড়ছেন উনারা কি লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি করেই সফল দেশপ্রধান হয়েছেন? আরেক দল ছাত্ররাজনীতির মডিফাই করতে চায়। তাদের মতে, দলভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ হওয়া উচিত। তবে ছাত্ররা ছাত্রদের রাজনীতি করবে। কোটাবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতন গুরুত্বপূর্ণ কাজে এগিয়ে আসবেন, ছাত্র সংসদ থাকবে ইত্যাদি। আরেক দল যুক্তি দিয়ে বলছে, রাজনীতি না থাকলে ছাত্রসমাজ ভেড়া হয়ে যাবেÑ ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। ক্যাম্পাসে হাতে গোনা কয়েকজন পদধারী নিজেদের অস্তিত্বের জন্য রাজনীতি করেন। পেছেনের বাকি ‘জি ভাই’ বলা হাজারখানেক সাধারণ শিক্ষার্থী কেউ সিটের জন্য, কেউ ধমকের ভয়ে, কেউ মাইরের ভয়ে মিছিল-মিটিংয়ে যান।

আমাদের ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-সংগ্রামে ছাত্ররাজনীতির কৃতিত্ব অপরিসীম, কিন্তু গত তিন দশকে ছাত্ররাজনীতির অর্জনটা কী আমাদের দেশে, দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, হত্যা, যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র ফাঁস পর্যন্ত এমন কোনো হীন কাজ নেই যার সঙ্গে তারা জড়িত না। এখন চাঁদাবাজিকে বলা হচ্ছে ফেয়ার শেয়ার, চিন্তা করা যায়, দুর্নীতিকে কীভাবে লেজিটিমাইজ করা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই এবং দলীয় ব্যানারে অপপ্রয়োগের কারণে এর প্রয়োজনীয়তাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ কী? জ্ঞান বিতরণ এবং উদ্ভাবন। কজন শিক্ষক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, তারা জ্ঞানচর্চা এবং উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত আছেন? কাজেই আমাদের প্রচলিত রাজনীতির খাই খাই দর্শনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সরাসরি সাংঘর্ষিক। মোদ্দাকথা, একটা দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে যখন পলিটিসাইজড করা হয়, তখনই সেখানে নৈতিক, আদর্শিক ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বন্ধ হয়ে যায় এবং রাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠন তৈরি হয়, যেমন বিশ্ববিদ্যালয় লাল দল, নীল দল ইত্যাদি। তখন সবাই ক্ষমতার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার জন্য নিজের রাজনৈতিক বলয় ও পলিটিক্যাল আইডেনটিটি তৈরি করে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ম্যানুপুলেট করে, যার ফলে প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় ক্ষমতাচর্চার কেন্দ্র এবং ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের কারখানা, যেটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে, আগাছার গোড়া রেখে আগা ছাঁটাই করে যেকোনো লাভ নেই, দেরিতে হলেও বুয়েট প্রশাসন সেটা বুঝতে পেরেছে এবং দলীয় ব্যানারে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা অত্যন্ত সাহসী এবং সময়োপযোগী।

আশা করি, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হর্তাকর্তাদেরও একটু আত্মোপলব্ধি হবে। সেই সঙ্গে সরকারেরও এটা ভেবে দেখা দরকার যে, কেন জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন আজ আদর্শ ও নৈতিকতাবিহীন একটা সন্ত্রাসী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, যা কি না পক্ষান্তরে সরকারের অনেক ভালো ভালো অর্জনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। এই দায়ভার কি ক্ষমতাসীনদের ওপর কিছুটা হলেও বর্তায় না? এখনই তাদের শক্ত হাতে দমন এবং সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে সরকারের জন্য এটা একটা বুমেরাং হবে। তাছাড়া শিক্ষক রাজনীতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো উপকার করেনি, বরং ক্ষতি করেছে অনেক বেশি। শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে দেশে সাধারণ জনগণের সমর্থন রয়েছে। বর্তমান ছাত্ররাজনীতির যে চর্চা, তার কারণে অনেকে এটি বন্ধ করার পক্ষপাতী। তবে এটি মনে রাখতে হবে, ছাত্রদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কোনোভাবেই ছাত্ররাজনীতিতে পড়ে না, সেটি সরাসরি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। কিন্তু এটাও সত্য যে, ছাত্র আন্দোলনের ফসল বাংলা ভাষা, স্বাধীনতা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য হচ্ছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তারা অধিকাংশই সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমেই এই পদে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তাই তারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের থেকে ভালো কিছু কখনই আশা করা যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ- ১৯৭৩ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উপাচার্যের নির্দেশনাই সব। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য এবং সিন্ডিকেট সদস্যরা থাকলেও এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ নেই। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করার জন্য উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে পদ্ধতিমূলক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন এবং এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

নব্বইয়ের দশকের পর দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। আর এই সুযোগে দলীয় রাজনীতি এবং ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের রাজনীতি শুরু হয়েছে সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কৌশলপত্রে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা বলা হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ছাত্রদের সংগঠিত হতে না দেওয়া এবং ছাত্রদের আন্দোলন বন্ধ করা। অতএব এটি কৌশলপত্র নয়, বরং একটি চক্রান্তপত্র। তাই এই সিদ্ধান্তের পেছনে বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পৃক্ততা আছে কি না; তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলেও মনে করে বিশেষজ্ঞ মহল। ক্যাম্পাসে আধিপত্য সুবিধাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কিংবা ছাত্রদল, শিবিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়? তার পরও কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না? তারা নিজেরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলেই তারা এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেন না। তাই এসব ব্যাপারে ভাবনা চিন্তার সময় এসেছে। অন্যতায় আমাদের শিক্ষার পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে সর্বমহলের অভিমত। শুধু দরকারি পড়ায় ছেলে ভালো মানুষ হতে পারে না। শুধু অন্নে পেট ভরলেও প্রাণ তুষ্ট হয় না। কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে; কিন্তু আহারটি রীতিমতো হজম করার জন্য হাওয়া খাওয়া দরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়কে সক্রিয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিক সামাজিকীকরণ ঘটবে এবং নেতৃত্বের গুণাবলি অধিক বিকাশ লাভের সুযোগ পাবে। পরিশেষে বলতে চাই, দেশজনতার স্বপ্ন-সাধকে পূরণ করতে হলে, কালের স্রোতে নিজেকে অমর করে রাখতে হলে, জীবনের বিদ্যালয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে, শিক্ষার আদর্শের প্রতি সবাইকে অতি সতর্ক ও যতœশীল হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close