নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৭ নভেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

পেঁয়াজ সংকট সমাধানে চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা

কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কৃষিবিজ্ঞানীদের নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি এবং সম্প্রসারণ কর্মীদের পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ফলে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। আলু উৎপাদনে অষ্টম। আম উৎপাদনে সপ্তম। যে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর শাকসবজি, ফলমূল ও সুগন্ধি চালসহ নানা ধরনের কৃষিপণ্য বিদেশে রফতানি করা হয়, সেই বাংলাদেশে কেন পেঁয়াজের সংকট হবে? বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সারা দেশে বিশেষ করে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, পাবনা, রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইলে রয়েছে পেঁয়াজ চাষের জন্য দক্ষ কৃষক। আছে বছরে দু-তিনবার চাষ করার মতো উচ্চফলনশীল অনেক জাত।

২৯ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার কর্র্তৃক বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের কারণে ৪০ টাকা থেকে প্রতি কেজির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ টাকায়। পেঁয়াজের মতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলার দাম চার গুণ বেড়ে যাওয়ার কারণে স্বল্প আয়ের ভোক্তাসাধারণ পড়েছে চরম বিপদে। মিসর, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেও দেশে পণ্যটির দাম সহনশীল পর্যায়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। জাতীয় প্রেস ক্লাবে সম্প্রতি (৩ নভেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে কনসাস কনজ্যুমারস সোসাইটি (সিসিএস) নামের একটি সংগঠন দাবি করেছে, গত ৪ মাসে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর কারণে ভোক্তাদের ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। রাজধানী ঢাকায় টিসিবির মাধ্যমে প্রতি কেজি ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করা হলেও, তা সারা দেশের বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ভারতের কর্ণাটকে প্রতি কেজি গোলাপি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে ১০ টাকা রুপিতে। কৃষকের আন্দোলনের কারণে ভারত সরকার চেন্নাই থেকে শর্তসাপেক্ষে সমুদ্রপথে বাংলাদেশকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সুমদ্রপথে কর্ণাটক থেকে পেঁয়াজ আমদানির অভিজ্ঞতা না থাকায় এতে কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। পেঁয়াজের দাম সহসা কমারও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না দেশে।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ না নিলে পেঁয়াজ নিয়ে এমন সংকট মাঝেমধ্যেই তৈরি হবে। আলু ছাড়া অন্য কোনো পণ্যের সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ভরা মৌসুমে দাম নিশ্চিত করা গেলে আর সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলেই কেবল পেঁয়াজ নিয়ে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যাবে। ক্যাবের সভাপতির বক্তব্যের সঙ্গে আমরাও সহমত পোষণ করি। পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্রীষ্ম-বর্ষাকালীন পেঁয়াজের চাষ, এর ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ ও সংরক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ওয়্যারহাউস নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পেঁয়াজ আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ১৯৪ হেক্টর এবং মোট পেঁয়াজ উৎপাদন ছিল ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর এবং মোট উৎপাদন ছিল ২৩ লাখ ৮০ হাজার টন। কৃষি সম্পসারণ অধিদফতর বলছে, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ৫৯ শতাংশ। অপরদিকে ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস)-এর তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৬০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। তাহলে কোনটি বিশ্বাস করব আমরা? অন্য এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২৪ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে প্রতি বছর বিদেশ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, যার সিংহভাগ আসে ভারত থেকে। সামান্য পরিমাণ আসে মিয়ানমার, মিসর ও চীন থেকে। সে হিসেবে চাহিদার ৫৪ ভাগ পূরণ হয় দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়ে এবং বাকি ৪৬ শতাংশ পূরণ হয় বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, যদি গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৮০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় এবং উৎপাদিত পণ্যের শতকরা ৩০ ভাগ পচে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলেও দেশে নষ্ট হওয়ার পর উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৬০ হাজার টন। এ থেকে যদি বীজ হিসেবে ২-আড়াই লাখ টন ব্যবহার করা হয়, তার পরও দেশে ব্যবহারযোগ্য পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ লাখ টন। সে হিসেবেও দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৯ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

এ কথায় পেঁয়াজ সংকট নিরসনে দেশে উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে, চাষে ও সংরক্ষণে দিতে হবে প্রণোদনা; যাতে কৃষক আমন ধান কাটার পর আলুর পরিবর্তে পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী হন। ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করতে হবে। এর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার এ বছর কৃষকের প্রণোদনা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ বছর প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষের জন্য এক কেজি বীজ, ২০ কেজি ডিএপিও ১০ কেজি এমওপি সার দেওয়া হবে। সব মিলে এই আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ১ হাজার ৭১৪ টাকা। মসলাজাতীয় ফসল চাষে শতকরা ৪ ভাগ সুদে কৃষিঋণ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ব্যাংকগুলো মসলাচাষিদের সেই ঋণ প্রদান করে

না। পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে হলে উৎপাদন এলাকায় মসলা চাষের ওপর কৃষকের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পেঁয়াজ উৎপাদনে উন্নত মানের বীজ একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে প্রতি কেজি পেঁয়াজবীজ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে স্বল্প দামে কৃষকের মধ্যে উন্নত জাতের পেঁয়াজবীজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পেঁয়াজ চাষের আর একটি সমস্যা হলো সংরক্ষণ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজ সংরক্ষণের ওপর নেওয়া হয় ‘পেঁয়াজ সংরক্ষণ কেন্দ্রের’ মতো কৃষকবান্ধব প্রকল্প। চিরাচরিত রবি মৌসুমে পেঁয়াজ চাষের রেওয়াজ থাকলেও বর্তমানে হুগলি জেলায় বর্ষাকালেও শুরু হয়েছে এর চাষ। দুই মৌসুমেই চাষের এলাকা বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যায় পেঁয়াজের উৎপাদন। ফলে উৎপাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ তৎপরতা শুরু করে জেলার উদ্যান পালন অধিদফতর। রবি মৌসুমে উৎপাদিত পেঁয়াজ জমি থেকে তোলার মাসখানেকের পর পচতে শুরু করে। পেঁয়াজ পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কৃষক পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না কৃষক। কিন্তু সংরক্ষণ ব্যবস্থায় কৃষক সেই পেঁয়াজ ৬ মাস পর্যন্ত নিজেদের হেফাজতে রেখে বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন। এজন্য হুগলি জেলায় গ্রহণ করা হয় কৃষকপর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণ প্রকল্প বা সংরক্ষণ কেন্দ্র। সংরক্ষণ কেন্দ্র বলতে ইটের গাঁথুনির ৩০ ফুট লম্বা একটি ঘর। চওড়া ২০ ফুট এবং উচ্চতা ১৫ ফুট। কাঠের বা বাঁশের মাচা করে তাতে গোছা করে ঝুলিয়ে রাখতে হয় পেঁয়াজ। এ ধরনের ১৮টি পেঁয়াজ সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে হুগলি জেলায়, যার অর্ধেক বানিয়েছেন বলাগড় ব্লকের বিভিন্ন গ্রামের চাষিরা। এক একটি পেঁয়াজ সংরক্ষণ কেন্দ্র তৈরিতে খরচ পড়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ভারতীয় রুপি, যার অর্ধেক ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা রাজ্য সরকার ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করে। আরো সংরক্ষণ কেন্দ্র তৈরির জন্য পেঁয়াজচাষিদের উৎসাহিত করতে পণ্যটি উৎপাদন মৌসুমের শুরু থেকে প্রতি ব্লকে সচেতনতা শিবির ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে জেলা উদ্যান পালন অধিদফতর। ভারতের হুগলি জেলার মতো আমাদের দেশেও পেঁয়াজ উৎপাদন এলাকায় এ ধরনের সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রয়োজন পেঁয়াজচাষির প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণে কৃষক

উদ্বুদ্ধকরণ। কৃষক পেঁয়াজ সংরক্ষণের সুবিধা পেলে এবং এর ন্যায্যমূল্য পেলে অবশ্যই আবাদ ও উৎপাদন বাড়াবেন। আর বাংলাদেশকেও পণ্যটির জন্য ভারতের ওপর এত নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না। ভোক্তাদেরও ১৫০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনতে হতো না। বাংলাদেশ খাদ্যশস্য ও শাকসবজির

মতো পেঁয়াজ উৎপাদনেও হবে স্বনির্ভর। এতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই উপকৃত হবেন। বাঁচবে দেশের কষ্টে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close