শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ
মুক্তমত
শ্রমের মূল্য নিশ্চিত করতে হবে
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের বিকাশ ঘটেছে ঈর্ষণীয়ভাবে। আমাদের পোশাকশিল্প বর্তমানে ভারত, জাপান, এমনকি চীনের সঙ্গেও পাল্লা দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের পোশাক পণ্য এখন চীনের বাজারে প্রবেশ করতেও সুযোগ খুঁজছে। আমেরিকা বাংলাদেশের পোশাক পণ্য রফতানির ওপর কোটা আরোপের পরও এ অগ্রগতি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। আর এ অগ্রগতির মূলে রয়েছে সস্তা শ্রমের অবদান। ১৯৯৪ সালে তৈরি পোশাকশিল্পের একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৯৩০ টাকা। তার ১২ বছর পর ২০০৬ সালে তা বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। এরপর সেটা বাড়িয়ে করা হয় ৩ হাজার টাকা। বর্তমানে একজন পোশাকশ্রমিক যে বেতন পাচ্ছেন, তার চাইতে কমপক্ষে বিশ গুণ বেশি বেতন পাচ্ছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের পোশাকশ্রমিকরা। আর এজন্যই ভারত, জাপান ও চীন পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের নাগাল ধরতে পারেনি।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজেদের আগের দাবি থেকে সরে এসেছেন শ্রমিকরা। এখন তারা ন্যূনতম মজুরি হিসেবে ১২ হাজার ২০ টাকা দাবি করছেন। এর আগে তাদের দাবি ছিল ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। যদিও এর সঙ্গে দ্বিমত করছে কিছু কিছু শ্রমিক সংগঠন। মজুরি বোর্ডের কাছে মালিকরা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করছেন ৬,৩৬০ টাকা। গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নতুন করে নির্ধারণের জন্য একটি মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। সে বোর্ডের তৃতীয় বৈঠকে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা ন্যূনতম মজুরি হিসেবে নিজেদের প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। এতে দেখা যায়, শ্রমিকদের প্রতিনিধি ১২ হাজার ২০ টাকা ন্যূনতম মজুরি হিসেবে প্রস্তাব করেছেন। মজুরি বোর্ডে নির্বাচিত শ্রমিক প্রতিনিধি বেগম শামসুন্নাহার ভূঁইয়া বলেছেন, আগের মজুরি বোর্ডের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই তিনি এ প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শ্রমিক ফেডারেশনগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মজুরির দাবি ছিল। কারো ছিল ১৬ হাজার টাকা, আবার কারো ১৮ হাজার টাকা। আমি সার্বিক বিষয় চিন্তা করে ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ২০ টাকা প্রস্তাব করেছি। আমি হিসাব করেছি, ২০১০ সালে শ্রমিকদের দাবি কত টাকা ছিল আর কত টাকা পেয়েছে আর ২০১৩ সালে দাবি কত টাকা ছিল আর কত টাকা পেয়েছে। এখন আমি ১৬ হাজার টাকা দাবি করলাম, কিন্তু পাওয়ার সময় যদি সেটা এক-তৃতীয়াংশ হয়ে যায়, তাহলে সমস্যা হবে। সেজন্য আমি ১২ হাজার টাকা প্রস্তাব করেছি।’
উল্লেখ্য, বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্পে একজন নতুন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৫,৩০০ টাকা, যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কার্যকর হয়। এর মধ্যে মূল মজুরি ৩ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া ১২০০ এবং চিকিৎসা, যাতায়াত ও খাদ্য ভাতা ১১০০ টাকা। মজুরি বোর্ড গঠনের আগে থেকেই শ্রমিকদের একটি বড় অংশ ১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করে আসছিল। বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেছেন, ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি শ্রমিকদের মজুরি এখন ১৬ হাজার টাকাও যথেষ্ট নয়, কারণ বাজারে সব জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে, আর আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি যা হওয়া উচিত কোনোটাই শ্রমিকরা পাচ্ছেন না। ফলে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
গত বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা অক্সফাম এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের সাতটি প্রধান তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরিই সবচেয়ে কম। অক্সফ্যামের রিপোর্টটিতে বলা হয়, বাংলাদেশে একজন সাধারণ মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য নিম্নতম মজুরি প্রয়োজন ২৫২ ডলারের সমান অর্থ। কিন্তু এ মুহূর্তে বাংলাদেশের একজন শ্রমিক মজুরি পান প্রায় ৬৭ মার্কিন ডলারের সমান অর্থ। পোশাকশিল্প আমাদের দিচ্ছে অনেক। জাতীয় অর্থনীতিতে রাখছে ব্যাপক অবদান। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৭৫ ভাগই আসে এ খাত থেকে। টাকার অঙ্কে উল্লেখ করলে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকা। তৈরি পোশাক রফতানির মাধ্যমে আমরা প্রতি বছর আয় করে থাকি প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এসব হিসাব-নিকাশ থেকেই আমরা বলছি, এসবই পোশাক সেক্টরের অবদান। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, আমরা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলা এ পোশাকশ্রমিকদের কথা, তাদের উদয়াস্ত অমানসিক পরিশ্রমের কথা বেমালুম চেপে রাখা হয়। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের হীনম্মন্যতা!
দেশের পোশাকশিল্পে বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে ৮০ ভাগই নারী। যারা প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা শ্রম দেন। কিন্তু আইএলও কনভেনশন কিংবা মহান মে দিবসের অর্জন ৮ ঘণ্টা কাজের সিদ্ধান্ত এদের বেলায় প্রযোজ্য হয়নি আজও। জীবিকার প্রয়োজনে নীরবে-নিভৃতে মেনে নিচ্ছে সব অনিয়ম। তারপরও এসব শ্রমিকের মজুরি বকেয়া রাখা হয় মাসের পর মাস। অনেক কারখানাতে দুর্ঘটনার সময় জীবন রক্ষার জন্য নেই কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা। মোট কথা হলো, আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ভিতকে যারা রক্ত-ঘাম আর শ্রম দিয়ে দিনের পর দিন শক্তিশালী করছেন তাদের কি দিচ্ছি আমরা? কিন্তু এক দিন কি এর জবাব চাইবে না পোশাক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকরা। সেদিন কি বলে আমরা তাদের সান্ত¦না দেব। তা জানার অধিকার ফল আমাদের নেই?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"