সাধন সরকার

  ২১ অক্টোবর, ২০১৯

আলোচনা

চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হোক

একটি দেশের প্রাণশক্তি হলো তরুণ জনগোষ্ঠী। তারুণ্যের শক্তি বা কর্মদক্ষতার ওপর ভর করে একটি দেশ উন্নতি লাভ করে। তবে তরুণদের মাঝেমধ্যে হতাশও হতে হয়! দুঃখের বিষয় হলো, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মর্মপীড়া কাজ করছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে গত কয়েক বছর থেকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে আসছে সাধারণ তরুণরা। বলতে দ্বিধা নেই, লাখ লাখ তরুণ সত্যিই আজ হতাশাগ্রস্ত! একাডেমিক পড়া শেষ করে চাকরির পড়া শুরু করার স্বল্প সময়ের মধ্যে বয়স ৩০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। ফলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হওয়ার কারণে হাজার হাজার তরুণ আর চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না! সদ্য চাকরির বয়স পার হওয়া তরুণদের প্রাণ গুমরে গুমরে কাঁদছে! বর্তমানে শিক্ষিতদের হার বেড়েই চলেছে এবং প্রতি বছর গেল বছরের চেয়ে আরো বেশি চাকরিপ্রত্যাশী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাস করে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ১৮-৩০ বছর। গড় আয়ু যখন ৪৫ ছিল, তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। গড় আয়ু যখন ৫০ পার হলো, তখন প্রবেশের বয়স হলো ৩০। বর্তমানে গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর, তাহলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স কেন ৩০-এ থমকে থাকবে? জাতীয় সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে বহুবার দাবিও উঠেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই! সত্যি বলতে মানসম্মত চাকরি পেতে হলে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে করতে প্রায় ২৫-২৬ বছর লেগে যাচ্ছে! চাহিদা ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। পৃথিবীর ১৬০টিরও অধিক দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এর অধিক। বাস্তবতা এটাই যে, বর্তমানে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে কিন্তু চাকরি নেই! ঘুষ-দুর্নীতির কারণে অনেকে আবার সময়মতো চাকরি পাচ্ছেন না! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! সহজ কথায়, একজন তরুণকে ‘৩০’-এর গন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা হচ্ছে! ফলে বয়স ৩০-এর মধ্যে চাকরি না পাওয়া একজন তরুণকে নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ‘৩০’ এ বেঁধে রাখার ফলে সব শিক্ষার্থীর মেধা কি আদৌ কাজে লাগানো যাচ্ছে? সরকারি নিয়ম অনুসরণ করার ফলে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে জনবল নিয়োগ দিচ্ছে না!

সম্প্রতি জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) থেকে তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশের অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তরুণদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন এবং দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। দেশের সব তরুণের সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে। তাই উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষিত তরুণদের কাজে লাগাতে দেশের উন্নয়নে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো প্রয়োজন। চাকরি পেতে সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এ দেশের সাধারণ ছাত্ররা, কেননা তাদের কোনো ধরনের কোটা নেই। চাকরি না পেয়ে সাধারণ ছাত্রের আত্মহত্যার কথা আমরা মাঝে মধ্যেই শুনতে পাই। সাধারণ ছাত্রদের কষ্টের কথা কেউ শোনেন না। এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা না বাড়ানোর পক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হচ্ছে, ঠিক একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল যখন ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়েছিল। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে কোনো প্রকার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, বরং তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগালে দেশ এগিয়ে যাবে, বেকারত্ব কমবে। অন্যথায় বড় ধরনের জনশক্তি অপচয় হবে! যুক্তি দেখানো হচ্ছে, এখন দেশে কোনো সেশনজট নেই। কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। সেশনজট আছে, তবে আগের থেকে কম। তাহলে আরো আগে যারা সেশনজটের শিকার হয়েছেন; সেসব লাখ লাখ তরুণের জন্য রাষ্ট্রের কী ব্যবস্থা আছে? আমি নিজেও প্রায় তিন বছরের সেশনজটের কবলে পড়েছিলাম। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো মানে তো চাকরি দেওয়া নয়। বরং একটি সম্ভাবনাময় শেষ হওয়া জীবনগাড়ির চাকা নতুন করে সচল করা! এতে বাড়তি টাকার অপচয়ও হবে না। যে যার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবেন। তাছাড়া একটু বেশি বয়সে চাকরিতে প্রবেশ করলে জ্ঞানের চর্চাও অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে বেকার তরুণদের জন্য বেকার ভাতা চালু আছে। কিন্তু আমাদের দেশে বেকার ভাতা না হোক, অন্তত চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে তরুণদের বেকারত্বের হাত থেকে তো মুক্তি দেওয়া যেতে পারে! যুক্তিসংগত ও সময়ের যুগোপযোগী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সব দিক বিবেচনা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার একাধিকবার সুপারিশ এসেছে জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’ থেকে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। তাই তরুণ সমাজের যুক্তিসংগত ও সময়ের দাবি, আরো বেশি সময় ধরে চাকরির প্রস্তুতি গ্রহণ ও বেকারত্ব দূর করতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করা হোক।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close