ড. মোহাম্মদ আলমগীর কবীর

  ২১ অক্টোবর, ২০১৯

নিবন্ধ

বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস ও দেশের পরিসংখ্যান

অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ অর্থাৎ গতকাল বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘ পরিসংখ্যান কমিশন তাদের ৪১তম অধিবেশনে (ফেব্রুয়ারি, ২০১০), ২০ অক্টোবর বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস পালনের সুপারিশ করে (সুপারিশ নং ৪১/১০৯)। জাতিসংঘ মনে করে, একটি দেশের উন্নয়ন সূচক, বিভিন্ন সেক্টরের নীতিনির্ধারণে, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে সঠিক ও সময়মতো পরিসংখ্যান অপরিহার্য। এই বিষয়টি বিবেচনায় এনে ৩ জুন ২০১০ সালে জাতিসংঘ তার সাধারণ অধিবেশনে ২০ অক্টোবরকে বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (Resolution A/64/267)। ওই বছরের ২০ অক্টোবর পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস পালিত হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর আনুষ্ঠানিকভাবে এ দিনটি উদযাপন করা হবে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর পৃথিবীব্যাপী অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে দিনটি পালিত হয় এবং ২০১৫ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “Better Data, Better Lives” অর্থাৎ উন্নত পরিসংখ্যান, উন্নত জীবন। যেকোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সঠিক ও সময়মতো পরিসংখ্যানের ব্যবহার অপরিহার্য। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল ও সময়মতো পরিসংখ্যানের প্রয়োগ খুব দ্রুতই উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে ও প্রকল্প গ্রহণে পরিসংখ্যানচর্চা একটি অতীব জরুরি বিষয়।

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিসংখ্যানচর্চা খুব বেশি দিন আগের নয়। অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেনের একক প্রচেষ্টায় ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ¯œাতকোত্তর শ্রেণিতে প্রথম পসিংখ্যান বিষয়ে পাঠদান শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫০ সালে তারই প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় এবং তিনিই ওই বিভাগের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের আগ পর্যন্ত তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশে পরিসংখ্যানচর্চা চলতে থাকে এবং বেশ কয়েকজন দেশবরেণ্য পরিসংখ্যানবিদের জন্ম হয়। এদিকে পরিসংখ্যানের সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহারের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পরসিংখ্যান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ওই ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক। অর্থাৎ ড. কাজী মোতাহার স্যারের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সংস্পর্শের কারণে এ দেশে পরিসংখ্যানচর্চা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং স্যারকেই বাংলাদেশে পরিসংখ্যান বিদ্যার জনক বলা হয়ে থাকে।

এদিকে অধ্যাপক খন্দকার মনোয়ার হোসেন স্যার ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ১৯৬৮ সালে অধ্যাপক ড. এম জি মোস্তাফা স্যারের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগ এবং স্যার ছিলেন ওই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭০ সালে সম্পূর্ণ আবাসিক ধারণা নিয়ে ঢাকার অদূরে প্রতিষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন চারটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা এবং পরিসংখ্যান বিভাগ ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। তখন ওই বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক এম ওবায়দুল্লাহ। এ বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা দেশে ও বিদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন এবং পরিসংখ্যানচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

১৯৭১ সালের স¦াধীনতা সংগ্রামের পর বাংলাদেশে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারার ফলে ও তাঁর দিকনির্দেশনায় ১৯৭৪ সালের আগস্টে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা চারটি পরিসংখ্যান অফিস (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষিশুমারি কমিশন এবং স্ব¦রাষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীন আদমশুমারি কমিশন)-কে একীভূত করে সৃষ্টি করা হয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। ২০০৮ সালে ২৩টি জেলায় ২৩টি আঞ্চলিক অফিস করা হয় এবং ৪৮৯ থানা/উপজেলায় অফিস নিয়ে এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে সাধারণ ও বিশেষায়িত মোট ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে; যার মধ্যে ১৯টিতে (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট; ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা; কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা; মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল; পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা; খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা; যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ; হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর; নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখাল) ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে পসিংখ্যান বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার পরিসংখ্যান বিষয়ের উচ্চতর ডিগ্রি যেমন এমফিল, পিএইচডি ও অন্যান্য গবেষণারও সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিসংখ্যান বিষয়ের পড়াশোনা সন্তোজনক নয়। বর্তমানে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পরিসংখ্যান বিষয়ে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে। পরিসংখ্যান বিষয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও অন্যান্য কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে একটি অথবা দুটি কোর্স সহায়ক কোর্স হিসেবে পাঠদান করানো হয়। নিকট ভবিষ্যতে এসব বিষয়ের মধ্যে পরিসংখ্যানের অধিক সংখ্যক কোর্স সংযোজন করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি কলেজে পরিসংখ্যান বিষয়ে পাঠদান

হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা বাড়ানো উচিত। আদর্শ কারিকুলাম ও পাঠদানে সক্ষম অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলীসহ যুগোপযুগী পাঠ্যপুস্তক ও অত্যাধুনিক কম্পিউটিং মেশিন প্রয়োজন।

দেশের সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সঠিক প্রকল্প গ্রহণে পরিসংখ্য্যন বিষয়ের জ্ঞান অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিসংখ্যান শাখা ও অন্যান্য আর্থিক এবং বিমা কোম্পানিতে পরিসংখ্যানবিদদের নিয়োগ অতি জরুরি। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংখ্যা ও কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সরকারি ক্যাডারেও পরিসংখ্যানবিদদের সংখ্যা ও মর্যাদা বাড়ানো প্রয়োজন, যেন তারা তাদের অর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে এবং দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। পরিসংখ্যানিক জ্ঞান ও ধারণা কাজে লাগানো এবং নতুন নতুন ধারণার সঙ্গে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের পরিচয় করিয়ে দিতে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, আলোচনা ও গবেষণালব্ধ তথ্যের আদান-প্রদান জরুরি।

লেখক : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close