রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২১ অক্টোবর, ২০১৯

মুক্তমত

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বড় চ্যালেঞ্জ

সাধারণ অবস্থায় মানুষ ও সমাজজীবন বিবর্তনের স্বাভাবিক ও মসৃণ পথে এগোয়। কিন্তু যখন মানুষের কৃত্রিম ইচ্ছার অনুপ্রবেশ ঘটে; তখন ছন্দপতন ঘটে ও সংঘাতের শুরু হয়। বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যখন বিঘœ ঘটে, তার প্রভাব কাটানোর জন্য বলপ্রয়োগের দরকার হয়। একেই ক্রপোটকিন বলেন ‘বিপ্লব’। সুতরাং বিবর্তন এবং বিপ্লব একে অপর হতে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, একে অস্বাভাবিক বা ধ্বংসাত্মক কিছু মনে করার কারণ নেই। তার মতে, পারস্পরিক সংঘাত নয় সহযোগিতাই মানুষের প্রধান প্রবণতা। আদিম সমাজে ছিল প্রকৃতির আইন। সেখানে শত্রুতার বদলে ছিল পারস্পরিক সহায়তা, সমব্যথা আর একে অপরের কষ্ট বোঝা। পারস্পরিক সহায়তা : ইতিহাসের উদাহরণ টেনে ক্রপোটকিন দেখান যে, যে প্রাণী যত উন্নত, তাদের মাঝে সহায়তার বোধ তত গভীর। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকারের মতো কৃত্রিম প্রতিষ্ঠানের অবাঞ্ছিত নাক গলানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সহায়তামূলক মনোভাব নষ্ট হতে থাকে। এর ফলে স্বাধীনতা, ন্যায় আর সদিচ্ছা হারাতে থাকে সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক লক্ষ্য হচ্ছে সাম্য, ন্যায্যতা আর সৌহার্দ অর্জন। কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান আর লোভ তার পথে বাধা। আর রাষ্ট্র হচ্ছে, এসব ঝামেলার প্রধানতম উৎস। স্বাভাবিক বিবর্তনের সঙ্গে রাষ্ট্র অপ্রাসঙ্গিক, কারণ তা মানবসৃষ্ট। সমাজ হচ্ছে স্বাভাবিক বিবর্তনের ফল। রাষ্ট্র সেই স্বাভাবিকতার সামনে বাধা। এই বাধার ফয়সালা করতে হবে। রাষ্ট্র ব্যক্তির ক্ষমতা বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা। এই রাষ্ট্রকে সরিয়ে ব্যক্তিকে তার বিকাশের জন্য তারই বেছে নেওয়া পথে চলার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর তা সম্ভব স্বতঃস্ফূর্ত পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে।

আদতে রাষ্ট্র খুব সাম্প্রতিক জন্ম নেওয়া এক প্রতিষ্ঠান। এর জায়গায় আসলে ছিল সহবোধ আর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সামাজিক সংগঠন। অর্থনৈতিক ক্ষমতা যখন সমাজকে শ্রেণিতে বিভাজিত করল, তখন থেকে সংঘাত শুরু হয়। সেই সংঘাতের ফয়সালা করার জন্য যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় তার নাম রাষ্ট্র। একই সঙ্গে শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য বহাল হয় আইন। এই আইন স্বাভাবিক সমাজপ্রথার জায়গা নেয়। সেই প্রথা ছিল সব মানুষের আর আইন হচ্ছে শাসকশ্রেণির স্বার্থে। শাসন, আইন ও ব্যক্তি সম্পত্তি হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিকতার পরিপন্থি। বিশ্বের বর্তমান পদ্ধতি দুর্বল মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারবে না। যারা সবল, তারা দুর্বলদের অধিকার আগেও কেড়ে নিয়েছে, আজও কেড়ে নিচ্ছে। প্রথমে তাদের দরিদ্র করে রাখা হয়। দরিদ্রদের মজদুর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর যখন মজদুরেরও প্রয়োজন হবে না, তখন বলা হয় তোমাদের পরিচিতি নেই, তোমরা অন্য জায়গা থেকে এই রাষ্ট্রে এসেছ। তোমরা হয় তোমাদের জন্য চিহ্নিত নিরাপদ স্থানে থাক, নতুবা অন্য রাষ্ট্রে চলে যাও। তোমরা কোনো রকমের ভোটাধিকার পাবে না। অন্য অধিকার পেলেও সেগুলো হবে অনেক সীমিত। রাষ্ট্র নিজেই জুলুম-নির্যাতন করে তার নিজের সীমানার মধ্যে বাস করা দুর্বল সম্প্রদায়গুলোর ওপর। পৃথিবীতে এখন কয়েকটা বড় রাষ্ট্র আছে। বড় বলতে ক্ষমতার দিক দিয়ে বড়। আবার কিছু রাষ্ট্র অত বড় না বলেও বড় রাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে এরা অনবরত ছোট রাষ্ট্রগুলোকে ধমক দিয়ে চলেছে। ছোট রাষ্ট্রগুলোর সম্পদকে এরা অতি তুচ্ছ মূল্যে কিনে নিতে চায়।

পৃথিবীতে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং আবার রাষ্ট্র ভেঙেও যায়। রাষ্ট্রের ধরন একেক সময়ে একেক রকম হয়। অতীতকালে ছিল সাম্রাজ্য। এরও আগে ছিল স্থানীয়ভাবে পছন্দমাফিক অথবা বাহুবলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সমাজপতিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনো পদ্ধতি। তবে মানুষ আদিকাল থেকেই স্বার্থপরতার নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল। সাম্রাজ্যে সাম্রাজ্যে যুদ্ধ হয়েছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে। মানুষ তার শেষ পরিণতিকে ভুলে এই দুনিয়ায় কিছু পাওয়ার জন্য পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের মতে মানুষকে সঠিক পথে রাখার জন্য তাদের সৃষ্টিকর্তা যুগে যুগে কেতাবসহ নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। এভাবেই সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতা চিন্তা করলে দেখা যায় এক অভিন্ন রূপ। যেকোনো দেশের সরকারের উপস্থিতি কেন প্রয়োজন হয়? শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। রাষ্ট্রের দরকার হয় একই জনপদের লোকেরা যাতে সবাই মিলে একত্রে তাদের জন্য স্বাধীনভাবে একটা জীবন পদ্ধতি বেঁচে নিতে পারে। কিন্তু আধুনিককালে আমরা পৃথিবীকে ভাগ করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছি। যদিও মানুষ এই পৃথিবীতে একই উৎস থেকে এসেছে, তবু আমরা রাষ্ট্র সৃষ্টি করে তাদের এক স্থান বা এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে চলেছি। রাষ্ট্রের লোকেরা যখন যুদ্ধবিগ্রহের শিকার হয়ে রাষ্ট্র কর্তৃক চিহ্নিত সীমানার বাইরে গিয়ে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় চায়, তখন আমরা তাদের বলছি রিফিউজি বা শরণার্থী। অথচ মানুষ এই দুনিয়ায় এসেছে তাদের সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় এবং সেই অর্থে এই ভুবনের সর্বত্রই তাদের স্বাধীনভাবে যাতায়াত করার স্বাধীনতা ছিল।

হতাশ হই এই ভেবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ই তো আমাদের সমাজকে উপযুক্ত ও মানসম্পন্ন মানবসম্পদের জোগান দেবে। কিন্তু যদি দেখি, সেগুলো থেকে বিদ্যাচর্চা বিদায় নিয়েছে এবং পদকে দখল করে অথবা পেয়ে নিছক স্বার্থপরতার একটা দৌড় চলছে, তখন বুঝতে হবে সামনের দিনগুলো আরো মন্দ আসছে। গেল দিন তো ভালোই গেছে বা কোনো রকমের গেছে। সামনের দিনগুলোর কথা ভাবুন। ভাবলে সুখ পান কি? কোনো আশাবাদ জাগ্রত হয় কি! তবু অনেকের মতো আমিও আশাবাদী। অনেক লোকের এই দেশে দুটি বিষয় সামনের দিনগুলোতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে। সেই দুটি বিষয় হলো শৃঙ্খলা রক্ষা করা। আর সমাজে একটা ন্যূনতম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এই দুটো বিষয় অর্জন করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে সামগ্রিকভাবে আমাদের দুঃখ শুধু বাড়বেই। কিন্তু গণতন্ত্র হলো অন্যের অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার জন্য একটা অতি সুপরিচিত বুলি। যেহেতু বুঝে হোক আর না বুঝে হোক রাষ্ট্রের নাগরিকরা গণতন্ত্র পছন্দ করে, সেই জন্য কোনো রাষ্ট্রচালককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য শক্তিধররা এই গণতন্ত্রের সেøাগানকে বেশ ভালোভাবে ব্যবহার করে। তবে এটাও সত্য, রাষ্ট্র যদি নিজে তার জনগণকে কথা বলতে না দেয়, তাহলে তো বুঝতে হবে রাষ্ট্র নিজেই অত্যাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এমন রাষ্ট্রের ধরনকে বদলে দিতে রাষ্ট্রের জনগণকে অনবরত সংগ্রাম করে যেতে হবে। রাষ্ট্রের জনগণ কি একত্রে ভুল করতে পারে? পারে, আবার পারেও না। তবু ভালো হলো রাষ্ট্রের জনগণকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে দেওয়া। যতক্ষণ না পর্যন্ত মতপ্রকাশ ধ্বংসাত্মক রূপ না নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রেরই উচিত মানুষের মতপ্রকাশকে উৎসাহ দেওয়া।

মনে রাখতে হবে, একক সিদ্ধান্ত দু-একবার শুদ্ধ হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই রাষ্ট্র যদি কল্যাণমুখী হয়, তাহলে জনগণের মতামত নেয়। শলাপরামর্শ করে এর শাসকরা রাষ্ট্র চালান। কল্যাণ রাষ্ট্রে সরকারের লোকেরা শাসন করেন না, তারা রাষ্ট্র চালান এবং চালাতে গিয়ে চিরদিন কেউ দায়িত্বে না থেকে অন্যদের দায়িত্ব প্রদানে আগ্রহী হন। সমাজ-রাষ্ট্র তখনই ভালো চলবে, যখন এর অধিবাসীরা ভালো লোক হয়। বিচারক-প্রশাসক, শিক্ষক-প্রকৌশলী, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আসবেন তো সমাজের চালকদের থেকেই। সমাজের লোকেরা যদি পচে যায়, তাহলে এসব পদের লোকেরাও পচা লোক হবে। এমনকি সমাজের লোকেরা স্বাভাবিকভাবে একটা ন্যায়ের কাঠামোর মধ্যে থাকবে। রাষ্ট্রের নিয়োজিত ব্যক্তিদের সমাজের জন্য আইন তৈরি করতে দিলে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এখানে এক পক্ষের ইচ্ছা বা স্বার্থ অপরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই আইন তৈরি করা লোকেরা এমন ভাব দেখায় যে, যাদের জন্য আইন তৈরি হচ্ছে তারা তাদের থেকে তাদের প্রয়োজন ভালো বোঝে। কিন্তু এই যে সমাজ তার ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে সঁপে দিল, তার কোনো উপযোগিতাই নেই। কারণ এমন বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, রাষ্ট্র সমাজের চাইতে ভালোভাবে কাজ করতে পারছে। ন্যায়বিচারের একটা স্বাভাবিক পন্থা আছে, যা মানুষ আদিকাল হতে কাজে লাগিয়ে আসছে। এর ভিত্তি আমাদের বিবেক, একে অপরের সঙ্গে সমঝোতার প্রথা। এগুলো বাদ দিয়ে আধিপত্যবাদী শাসকশ্রেণির মাইনে পাওয়া একদল পেশাজীবীর হাতে তৈরি হওয়া আইনের অধীনস্ত হওয়া যৌক্তিক নয়। রাষ্ট্র ও আইনি ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা সংঘাত নিরসনের একটা পরোক্ষ ব্যবস্থা জন্ম দেয়।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close