এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

নিরাপদ খাদ্যের চ্যালেঞ্জ

মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে খাদ্যের অধিকার নিয়ে। আর এ অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশে নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা সামনে রেখে তা বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছে। পৃথিবীতে অধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে খাদ্য উৎপাদনও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য ঘাটতি আগের মতো নেই বললেই চলে। তবে পৃথিবীব্যাপী বিশাল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদনের নামে যেসব খাদ্য মানুষ ঘরে তুলছে, আসলে তা কতটুকু নিরাপদ, সেটা বর্তমানে প্রশ্নসাপেক্ষ। পৃথিবীতে খাদ্যের অভাবে অনাহারে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমেছে। কিন্তু খাদ্য গ্রহণের ফলে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেÑ এমন মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্থ থাকার জন্য শুধু খাদ্য নয়, ‘নিরাপদ খাদ্য’ প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের কারণে অধিকাংশ মানুষ নিজের অজান্তেই অসুস্থ ও রোগাক্রান্ত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এ কারণে প্রতি বছর মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সি শিশুদের ৪৩ শতাংশই খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়, প্রতি বছর প্রাণ হারায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু। জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই স্যালমোনেলা জীবাণু বহনকারী আইসক্রিম খাওয়ার ফলে ২ লাখ ২৪ হাজার মানুষ রোগে আক্রান্ত হয়। ১৯৮৮ সালে দূষিত শামুক ও গলদা চিংড়ি খেয়ে চীনে প্রায় তিন লাখ মানুষ রোগাক্রান্ত হয়। ২০০৮ সালে চীনে তৈরি কয়েকটি কোম্পানির গুঁড়ো দুধ পান করে বহু শিশু রোগাক্রান্ত হয়। ওই দুধে মেলামাইনের মাত্রা বেশি ছিল। বাংলাদেশেও এ দুধ আমদানির মাধ্যমে আসে। সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে সরকার ওই দুধসহ উন্নত দেশের কটি ব্র্যান্ডের দুধ আমদানি নিষিদ্ধ করে। পরে আমদানিকারকরা এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা করলে আদালতের নির্দেশে সবগুলো ব্র্যান্ডের দুধ বিদেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর আমদানির জন্য কয়েকটি ব্র্যান্ডকে ছাড়পত্র দেয়।

খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। ১৬ কোটির জনবহুল বাংলাদেশে ‘খাবারে বিষ’ একটি আতঙ্কের নাম। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে ফসল উৎপাদনে পোকা দমনে যত্রতত্রভাবে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েই চলছে। কোনো নিয়ম না মেনে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি তার স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে সঙ্গে ফসল অনিরাপদ করে তুলছে। ফলে মানুষ নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ভেজাল খাদ্য, বিষাক্ত খাদ্য, রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো খাদ্য, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যে বাংলাদেশ সয়লাব হয়ে গেছে। দেশের ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থযুক্ত ফল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য, মাছ, মাংস, ডিম, দুধসহ প্রায় সব খাদ্য-ই এখন আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ এখন শঙ্কামুক্ত হয়ে কোনো খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। লক্ষ করা গেছেÑ ফল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য দ্রুত বৃদ্ধি, পাকানো, আকর্ষণীয় করা, সংরক্ষণ, রোগ ও পোকা দমনের জন্য অসাধু ব্যবসায়ী ও কৃষকরা রাসায়নিক পদার্থ, হরমোন এবং কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। অথচ এসব বিষাক্ত ও ক্ষতিকর পদার্থ ছাড়াও কৃষিপণ্য উৎপাদন, পাকানো এবং সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু আমাদের কৃষি তো সে পথে যাচ্ছে না।

দেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে। নতুন নতুন ধান এসেছে। উচ্চফলনশীল এসব ধান দেশে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছি। ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির গবেষণায় যে তথ্য মিলেছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ। গবেষণার জন্য চালের যে ২৩২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, তার ১৩১টিতেই মিলেছে বিভিন্ন মাত্রার ক্রোমিয়াম। ১৩০টিতে পাওয়া গেছে ক্যাডমিয়াম ও সিসা। ৮৩টিতে মিলেছে আর্সেনিকের অস্তিত্ব। খাদ্য অনিরাপদ শুধু কৃষক পর্যায়ে হচ্ছে না, অসাধু ব্যবসায়ী এবং অসচেতন ভোক্তা পর্যায়ে খাদ্য অনিরাপদ হওয়ার কারণে জনগণ চরম স্বাস্থ্যঝুকির মধ্যে রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য সঠিকভাবে উৎপাদন করতে না পারায় জাতির মেধা ধ্বংস হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিণতি কমবেশি সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে শিশুরা। বিশেষ করে সঠিক মান রক্ষা করে এবং প্রয়োগবিধি না মেনে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে একাধারে উৎপাদিত ফসল, মাছ, পানি ও জমি মারাত্মকভাবে বিষাক্ত হয়ে থাকে। এর যেকোনো মাধ্যম থেকে মানুষের শরীরে সহজেই ঢুকে পড়ছে এই বিষাক্ত উপাদান। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসল ও মাছে ভারী ধাতু ঢুকছে মূলত মাটি ও পানি থেকে। মাটি ও পানি এমনভাবে রাসায়নিক দূষণের কবলে পড়ছে, যা খাদ্যচক্র হয়ে মানবদেহে ঢুকে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। নানা ধরনের জটিল রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে মানুষকে।

বাংলাদেশের জন্য এখন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে ‘নিরাপদ খাদ্য’। বিশ^ খাদ্য দিবসসহ বিভিন্ন উপলক্ষে ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্যের কথা উচ্চারিত হয়ে থাকে। তখন বিভিন্ন উদ্যোগ ও আশ^াসের কথা শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, খাদ্যে ভেজাল ও বিষের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা যেন অক্ষম ও অসমর্থ হয়ে পড়েছি। অথচ দেশে আইনের তো অভাব নেই। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রি করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- এবং ১৪ বছরের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ের বিধান রয়েছে। মাঝেমধ্যে বিএসটিআইয়ের ভেজালবিরোধী অভিযান, প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট এবং পরিবেশবাদীদের আন্দোলনও লক্ষ করা যায়। তারপরও দেশের মানুষ নিরাপদ খাদ্য পাচ্ছে না। এই সংকট থেকে কি জনগণের মুক্তি নেই? মানুষ কি কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ করে অসুস্থ হতেই থাকবে? সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে কি নাÑ সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে এখনই প্রয়োজন সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন তৈরি করে সরকার। ২০১৫ সালে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়, এই আইনের আওতায় ২ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে তারা। একজন ভোক্তা ও ক্রেতা হিসেবে প্রথমত আমরা খাদ্যকে নিরাপদ দেখতে চাই। নিরাপদ খাবার পেতে সব ক্ষেত্রে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং আইন অমান্যকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভেজাল বা মানহীন খাদ্য সরবরাহ করে যাতে কেউ পার না পায়, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে। শাস্তিটা লোক দেখানো উদাহরণ হলে হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনভঙ্গকারীকে বিচারের আওতায় আনতে পারলেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা যাবে। জমির মাটি থেকে খাবার থালা পর্যন্ত খাদ্য নিরাপদ হওয়া জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close