ইসমাইল মাহমুদ

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৯

মুক্তমত

নির্বাসনে মনুষ্যত্ব

যার জীবন আছে সে-ই জীব। মহান আল্লাহ তায়ালা জড় ও জীব মিলে ৮০ হাজার বস্তু সৃষ্টি করেছেন। স্থলভাগে ৪০ হাজার এবং পানিতে ৪০ হাজার। এসব সৃষ্টির মধ্যে জিন, ফেরেশতা ও মানুষ সেরা; তবে মানুষই আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে স্বীকৃত। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আমি আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং তাদের পানিতে ও স্থলে প্রতিষ্ঠিত করেছি। তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের অনেক সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা ইসরা : ৭০)।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু এই মানুষই আবার কর্মের কারণে বর্তমান সময়ে সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব বলে পরিগণিত। যে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ থাকে না, তাকে মানুষ বলা যায় না। মানুষ বলতে মানুষের ভেতর মানবীয় গুণ থাকতে হয়। মানবিক আচরণ থাকতে হয়। শুধু মনুষ্যকুলে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে মানবিক গুণ, নৈতিকতা, সহিষ্ণুতা থাকতে হয়। মানুষের চিন্তা-চেতনার বিকাশ, বিবেকবোধ, কা--জ্ঞান আর বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতার কারণে মহান আল্লাহ তা’আলা ৮০ হাজার বস্তুর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মানুষ মনুষ্যত্বের অধিকারী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। মানবতা বা মনুষ্যত্ববোধ না থাকলে মানুষ কখনোই মানুষ নয়। কিন্তু বর্তমানে প্রাত্যহিক লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, উগ্রতা, স্বার্থপরতা, ক্রোধ প্রভৃতি কারণে মানুষের মনুষ্যত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। এক কথায় মনুষ্যত্ব আজ নির্বাসনে।

এই পৃথিবীতে সন্তানের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো তার বাবা ও মা। একজন মানুষ যদি পৃথিবীর সব মানুষ কর্তৃক অবহেলিত হয় বা তার কাছে সুন্দর পৃথিবী যখন অন্ধকারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন হতাশার চাদরে আবৃত সেই মানুষের কাছে বাবা-মা আশার প্রদীপ, শান্তির বাতিঘর, নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমান সমাজে নিজ পরিবারই যেন নিরাপত্তাহীন। প্রতিপক্ষেকে ঘায়েল করতে নিজ বাবা বা মা সন্তানকে বলি বানাচ্ছেন। আজ যেন আমরা পাশবিকতার ষোলোকলা পূর্ণ করছি। আমাদের মধ্যে আজ যেন মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই। আমরা আজ যে মনুষ্যত্বহীন সমাজে বাস করছি, তার দায় কিন্তু আমাদেরই। আমরা দিনে দিনে আমাদের সমাজটাকে একটা চরম বর্বরতার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি। মানুষের মনুষ্যত্ব যখন চরমভাবে লোপ পায়, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে ওঠে হায়ে না। তখন সমাজে দ্রুত বেড়ে যায় অপরাধপ্রবণতা। খুন, গুম, ধর্ষণ, লুটপাট, চুরি, ডাকাতি, ইভটিজিং, প্রতারণা, চাঁদাবাজি, ঘুষ, অপহরণ, দুর্নীতি, অরাজকতা, মিথ্যা বলা, অন্যের ক্ষতি, অন্যকে বিপদে ফেলা ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টি ইত্যাদি কাজ প্রতিনিয়তই সংঘটিত হতে থাকে।

সমাজে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ভালো এবং মন্দের দ্বন্দ্ব থাকবে। আর এটাই স্বাভাবিক। সব খারাপ বা মন্দকে পরিহার করে ভালো বা সৎ কর্মকে বেছে নেওয়া, ভালো পথ অনুসরণ করা মনুষ্যত্বের অন্যতম কাজ। আদর, দয়া, মায়া, মমতা, বিনয়ী, ক্ষমা, স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা, উদারতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সততা, ধৈর্য, ত্যাগ, সহনশীলতা, সহানুভূতি, সৌজন্য, আদব-কায়দা, শৃঙ্খলা, কল্যাণ চিন্তা, ভালো ব্যবহার ইত্যাদি হচ্ছে একজন মানুষের মনুষ্যত্বের মূল উপাদান। সমাজে প্রতিটি মানুষের মধ্যে লোকায়িত থাকে মনুষ্যত্ব। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সেই মনুষ্যত্বকে লালন করার কথা। কিন্তু আজ কোথায় সেই মনুষ্যত্ব? মারামারি-হানাহানিসহ সব অপরাধমূলক কর্মকা- আজ যেন ‘ডাল-ভাত’।

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই সমাজের প্রতিটি শিশু নিজের পরিবারের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে গণ্য। আজ সেই নিরাপদ স্থানটি তাসের ঘরের মতো উবে গেছে। হজরত শাহজালাল (র.) ও হজরত শাহপরান (র.)-সহ অলি-আউলিয়াদের পুণ্যভূমি হিসেবে খ্যাত সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কেজাউড়া গ্রামে জন্মদাতা বাবা, চাচা, চাচাতো ভাইসহ নিজ পরিবারের সদস্যরা একটি শিশুকে বীভৎসভাবে হত্যার পর গাছে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় দেশের বিবেকবান মানুষের আন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষমাত্রই শিউরে উঠেছেন। এটি কোনো উন্নয়নশীল ও আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না।

পাঁচ বছর বয়সের কোমলমতি ছোট্ট ফুটফুটে শিশু তুহিন মিয়া। সোমবার নিজ বাড়ির পাশে একটি কদমগাছের ডালে ঝুলছিল তার নিথর দেহটি। কান দুটি কাটা, নৃশংসকভাবে তার যৌনাঙ্গটিও কেটে ফেলা হয়েছে। পেটে দুটি ছুরি ঢোকানো। ছুরি দুটিতে এলাকার সোলেমান ও সালাতুল নাম দুটি লেখা। এই কোমলমতি শিশুটি পারিবারিক কলহের কারণে নিজের পরিবারের নিশানায় পরিণত হয়েছে!

শিশু তুহিনকে বর্বরোচিত কায়দায় হত্যার ঘটনা সারা দেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার নিথর মৃতদেহ উদ্ধারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাৎক্ষণিক তৎপর হয়ে ওঠে। সন্দেহজনক আচরণের কারণে পুলিশ আটক করে শিশু তুহিনের বাবা, চাচা, চাচাতো ভাইসহ পরিবারের আরো কয়েক সদস্যকে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আটকরা ফুটফুটে শিশু তুহিন খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শিশু তুহিনকে নিজের পরিবারই বলি বানিয়েছে। শিশু তুহিন হত্যায় জড়িত তিনজন। তারা হলো শিশুটির জন্মদাতা বাবা আবদুল বাছির, চাচা নাছির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার। খুনিদের বর্ণনা মতে, গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় শিশু তুহিনকে কোলে করে ঘরের বাইরে বের করে আনে তার জন্মদাতা বাবা। আর যে স্থান সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সেই বাবার কোলেই ঘুমন্ত অবস্থায় শিশু তুহিনকে ছুরি দিয়ে গলা কেটে খুন করেন চাচা নাসির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার। তারপর শিশুটির কান ও যৌনাঙ্গ কেটে পেটে দুটি ছুরি ঢুকিয়ে তার মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয় কদমগাছের ডালে। পরে এ ঘটনার দায় স্বীকার করে সুনামগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে তুহিনের বাবা ও চাচা। পুলিশ জানিয়েছে, তুহিনের হত্যাকারী বাবা, চাচা ও চাচাতো ভাই আরো দুটি হত্যা মামলার পাশাপাশি দুটি মামলার আসামি। পারিবারিক বিরোধ ও এক হত্যা মামলার জেরে বলি হলো তুহিন। বাবা আবদুল বাছির প্রতিপক্ষের করা হত্যা মামলার আসামি। ওই মামলা থেকে নিজেকে বাঁচাতে এবং প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের ঔরসজাত সন্তানকে নৃশংসভাবে বলি বানায় মানুষ নামের অমানুষ আবদুল বাছিরসহ তার পরিবারের সদস্যরা।

দেশে পারিবারিক বিরোধের বলি শিশুহত্যার ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন ঘটনা। প্রায় সব ঘটনাতেই আসামিদের নিয়ে আসা হচ্ছে বিচারের কাটগড়ায়। বিচার হচ্ছে, তবে তাতে রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। অনেক সময় আসামিরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেসব ঘটনায় বিচারের রায় হচ্ছে, সেসব রায় অনেক কালক্ষেপণ করেও কার্যকর হচ্ছে না। ফলে দেশে একের পর এক শিশুহত্যার শিকার হচ্ছে। তুহিন হত্যার ঘটনায় দেশের আপামর মানুষের দাবি, দ্রুততম সময়ে বর্বরোচিত এ হত্যার বিচার হোক। বিচারে প্রদত্ত দ- দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর হোক।

মানুষের মধ্যে জাগ্রত হোক মানুষের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া ও মমতা। মানবতা ও মনুষ্যত্বের বিষয়টি পুরোপুরি মানুষের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। মানুষ একমাত্র তাদেরই বলা যায়, যাদের মানবতা এবং মনুষ্যত্ব জ্ঞান বলে কিছু একটা আছে। কামনা করছি আমাদের দেশ তথা পুরো বিশ্বে শিশুর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, নির্যাতন, শিশুহত্যা নেমে আসুক শূন্যের কোঠায়। মানুষের বিবেক জাগ্রত হোক। প্রায় নির্বাসনে যাওয়া মনুষ্যত্ব আবার ফিরে আসুক।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close