ইসমাইল মাহমুদ
মতামত
এখনো অবহেলিত গ্রামীণ নারী
১৫ অক্টোবর ছিল বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। পরিবার ও সমাজে গ্রামীণ নারীর অবস্থান ও কর্মের মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ফলে ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ দিবস পালন করে আসছে। তবে এর আগে ১৯৯৫ সালে গ্রামীণ নারীর খাদ্য উৎপাদনসহ সমাজের নানামুখী ভূমিকা পালনের স্বীকৃতির জন্য বেইজিং সম্মেলনে প্রতি বছরের ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ নারীর বহুমাত্রিক ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। তাদের যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়ার জন্য আন্দোলন চলছে যুগের পর যুগ ধরে। তবে বর্তমান সরকারের সময়ে দেশে নারীর ক্ষমতায়নসহ সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে নারী ধীরে ধীরে উন্নতি আর অগ্রগতির পথে। সমাজের অগ্রগতিতে এখন শহুরে নারী ও পুরুষের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীও অবদান রেখে চলেছেন।
আমাদের দেশে কৃষি খাতের ২০টি কাজ রয়েছে। এরমধ্যে গ্রামীণ নারী ১৭টি কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তথাপিও কৃষি খাতে নারীর কোনো স্বীকৃতি নেই। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, ফসল সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ১৭টি কাজে অংশগ্রহণ থাকলেও গ্রামীণ নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন পান না। অনেক সময় গ্রামীণ নারী পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেন। কৃষি খাতের ২০টি কাজের মধ্যে ১৭টিতে গ্রামীণ নারী সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেও কৃষি খাতের ঋণ ও সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকেও গ্রামীণ নারী আজীবন বঞ্চিতই থেকে যান।
একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। এ অর্ধেক নারীর মধ্যে শতকরা ৮৬ শতাংশ বসবাস করেন গ্রামীণ জনপদে। গ্রামীণ নারী দিনের মোট সময়ের মধ্যে শতকরা ৫৩ ভাগ ব্যয় করেন কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্প ক্ষেত্রে। অন্যদিকে যেখানে পুরুষ ব্যয় করেন শতকরা ৪৭ ভাগ সময়।
অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের মোট নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৭০ লাখ। এরমধ্যে ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। যার মধ্যে ৬৮ শতাংশ কৃষি, পোলট্রি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া গ্রামীণ নারী গৃহকর্মী, উন্নয়ন কাজের সহযোগী (ভবন তৈরির জোগালি নামে পরিচিত), ইটভাঙার কাজ, পার্লারের কর্মী, ক্লিনিক ও হাসপাতালের নার্স, স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মীসহ নানা ধরনের কর্মে নিয়োজিত থেকে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্বল্প মজুরিতে গ্রামীণ নারীকে এসব কর্মে নিয়োজিত করছে। ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা’ (বিআইডিএস)-এর এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে গ্রামীণ নারীর মধ্যে ৪১ শতাংশ নারী আলু চাষের সঙ্গে এবং ৪৮ শতাংশ মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত।
আমাদের দেশে মোট কর্মজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এরমধ্যে দেড় কোটির ওপরে গ্রামীণ নারী। দেশে গার্মেন্টশিল্প, কৃষিকাজ, কুটিরশিল্প, আসবাবপত্র তৈরিসহ নানাবিধ কাজে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। নারী পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। গৃহস্থালি কাজসহ বহুমুখী কাজের সঙ্গে গ্রামীণ নারী সরাসরি যুক্ত রয়েছেন। গৃহস্থালি কাজ ও কৃষিকাজে গ্রামীণ নারীর অধিক অংশগ্রহণ থাকলেও কৃষিকাজে গ্রামীণ নারীর অবদান এখনো মূল্যায়ন করা হয় না। নারীর গৃহস্থালি কাজ ও কৃষিকাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে নারীর প্রতি বৈষম্য এবং নির্যাতন অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এ ছাড়া জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি প্রদান করা অত্যাবশ্যক। গবেষকরা জানান, নারীর অমূল্যায়িত বা গৃহস্থালি কাজের সঠিক মূল্য জিডিপি হিসেবে যুক্ত করার জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশ সমৃদ্ধির পথে আরো এগিয়ে যাবে।
দেশের আজকের বিশ্বখ্যাতি অর্জনের পেছনে গ্রামীণ নারীর ব্যাপক অর্জন ও প্রচেষ্টা রয়েছে। যদিও গ্রামীণ নারী এখনো অবহেলার পাত্রী হিসেবে পরিগণিত। শুধু বর্তমানেই নয়, আবহমান কাল ধরে গ্রামীণ নারী গৃহকর্ম ও কৃষিকর্মে শুধু শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তারা যে শুধু গৃহকর্ম ও কৃষিকর্মে শ্রম দিচ্ছেন, তা নয়। বিদেশি রেমিট্যান্সেও গ্রামীণ নারীর অবদান কম নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের যত নারী প্রবাসে কর্মরত রয়েছেন তার ৭৯ শতাংশই গ্রামীণ। প্রবাসে চাকরিরত গ্রামীণ নারীর কষ্টার্জিত অর্থে দেশের অর্থনীতি হচ্ছে সমৃদ্ধ। আর গার্মেন্ট সেক্টর তো আমাদের দেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। এ শিল্প এখন একচেটিয়া নারীর দখলে। গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদের শতকরা ৯২ শতাংশই গ্রামীণ জনপদের।
মজুরিবৈষম্য, যথাযথ সম্মান ও কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া বঞ্চনাক্লিষ্ট এই নারীর পরিবার ও সমাজে অবস্থান ও কর্মের মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে আজ সারা বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস’। ঘরে-বাইরে গ্রামীণ নারী নিরাপত্তা, কাজের স্বীকৃতি, যথাযথ মজুরি পাকÑ সেটাই হোক আজকের দিবসের মূল অঙ্গীকার।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট
"