রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৭ অক্টোবর, ২০১৯

মুক্তমত

বন্ধ হোক লক্ষ্যভ্রষ্ট ছাত্ররাজনীতি

ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান ও স্বাধীনতাযুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এবং ইতিহাস রয়েছে; সেই অবস্থান থেকে বর্তমানের ছাত্ররাজনীতি পুরো উল্টোপথে এগোচ্ছে। ২০১৪ সালের জুন মাসের ১৭ তারিখের নির্মম ঘটনার কথা সবারই জানা, তার পরও আবার মনে করিয়ে দিলাম। ঘটনাটি ছিল এমন, সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রকে তারই সহপাঠীরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। যেসব মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের বাঁচিয়ে তুলবেÑ এমনটি সবাই আশা করেছে। কিন্তু পত্রিকার পাতায় খবর এসেছে ওকে ওরা পিটিয়ে জখম করে মেরেই ফেলেছে। ওরা কারা? খবরে প্রকাশ ওরা মেডিকেল কলেজে পড়ে। ওরাও ডাক্তার হবে। কিন্তু কী ভয়ংকর সংবাদ। যারা হবে চিকিৎসক তারাই হাসতে হাসতে ডাক্তার হওয়ার আগেই মানুষ খুন করতে শিখে গেছে। হায় মানবতা। পরে জানা গেছে, ঘটনার পেছনে দুই দলের ছাত্ররাজনীতি জড়িত ছিল। তখন অনেকেই বলেছেন, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার সময় হয়েছে। এরপর জল অনেক গড়িয়েছে। এখন ২০১৯ সাল। এই কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্রের প্রাণ লুটিয়ে পড়েছে সবুজ ঘাসে শুধু ছাত্র সংগঠনের বিরোধের কারণে। সম্প্রতি ঢাকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেøাগান তুলছেÑ ‘আবরারের খুনিদের ফাঁসি চাই, দিতে হবে। আইন কী বলে, তা আইন বিশেষজ্ঞরা ভালো জানেন। তবে ওই শিক্ষার্থীদের বিচার দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। সারা বাংলাদেশ জেনে গেছে কুষ্টিয়ার মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হলে পিটিয়ে হত্যা করেছে। সে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

কী নিষ্ঠুর! কী নির্মম! বাইরের কোনো সন্ত্রাসী বা ছিনতাইকারী নয়। তার আপন বিদ্যাপীঠের তারই ভাইরা তাকে মেরে ফেলল। অক্টোবরের প্রথম রোববার রাত ২টার দিকে খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তড়িৎকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র আবরারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে এ পর্যন্ত যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, খবরে প্রকাশ ওরা জড়িত এবং ওরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেক সচেতন মানুষ বর্তমান ছাত্ররাজনীতির ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলেছেন, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে দলীয় ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি না করেও উন্নত চিন্তা শক্তিসম্পন্ন ও মেধাবী রাজনীতিবিদ জন্ম নিয়েছে। আমরাও মনে করি, ২০১৪ সালের জুনে সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্র তাওহীদুল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদ পর্যন্ত যত শিক্ষার্থী শুধু এ সময়ের ছাত্ররাজনীতির কারণে মারা গেছে; তেমন ছাত্ররাজনীতি কোনোভাবেই এই দেশ ও এই জাতির জন্য শুভকর নয়। এ আমাদের কলঙ্কের। এ আমাদের অভিভাবকের ব্যর্থতা। আবরার ফাহাদের কথা বলতে গিয়ে জেনেছি, অনেক শিক্ষক কেঁদেছেন। কিন্তু কেন নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো আবরারকে? তার অপরাধ কী? আবরারকে তার রুম থেকে ডেকে নিয়ে হকিস্টিক দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পেটানো হয়েছে এবং একপর্যায়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রচলিত ধারার ছাত্ররাজনীতি রাখার প্রয়োজন আছে কি না; সে বিষয়ে। ছাত্ররাজনীতি সাময়িক সময়ের জন্য হলেও নিষিদ্ধের বিষয়টি সামনে এলে অনেকেই রে রে করে ওঠেন। বলেন, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব পাব কোত্থেকে? তাছাড়া বাংলাদেশটাই তো গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র-আন্দোলন ও ছাত্ররাজনীতির ফসল। হ্যাঁ, আমাদের ছাত্র-আন্দোলনের অতীত ঐতিহ্য নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কিন্তু সময় বদলেছে। বাস্তবতাও বদলেছে। এখন আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম বলে বিলাপ করে কোনো লাভ নেই। আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা এটা বলে না যে, রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছাত্র সংগঠন দিয়ে ইতিবাচক কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব। ছাত্ররাজনীতি তার গৌরবোজ্জ্বল দিক হারিয়েছে। আগে সংকট ঘনীভূত হলে ছাত্ররা পথে নামত। এখন টেন্ডার বাণিজ্য, লুটপাট, চাঁদাবাজিই ছাত্ররাজনীতির পরিচয় বহন করে। তাহলে যে সংগঠন গঠনমূলক কাজের পরিবর্তে ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত, সে সংগঠন জিইয়ে রাখলে আদতেই ক্ষতি বই লাভ নেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক সমিতির সভাপতি একেএম মাসুদ মঙ্গলবার বুয়েট শহীদ মিনারে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের মাঝে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমরা অভিভাবক হিসেবে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা শিক্ষকরা বলি, প্রশাসন বলি, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। সম্মানিত শিক্ষকদের দায় স্বীকার থেকে প্রমাণ হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্ররাজনীতি ভালো ফল দিচ্ছে না। তাই ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার জন্য একটি কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে ওকালতি করে, ছাত্র-আন্দোলনের অতীত ঐতিহ্যের ধুয়া তুলে বর্তমানকে জাস্টিফাই করা অর্থহীন। যে ছাত্ররাজনীতি বিবেকবান নেতৃত্ব তৈরি করার পরিবর্তে খুনি, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ঠ্যাঙারে তৈরি করে; সেই ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই।

মাথাব্যথার ওষুধ মাথা কেটে ফেলা অবশ্যই নয়। আবার হাত বুলিয়েও প্রচন্ড মাথাব্যথা দূর করা যায় না। ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চার পরিধি বাড়িয়ে ছাত্র সংগঠনের অন্যসব তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সেসঙ্গে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ করতে হবে শিক্ষকদের সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিও। শিক্ষকদের রাজনৈতিক মত ও বিশ্বাস থাকতেই পারে, একজন সচেতন মানুষের রাজনীতি সমর্থন দোষের কিছু নয়, কিন্তু প্রকাশ্যে দলবাজি করা শিক্ষকতা পেশার নৈতিকতার পরিপন্থি। তাই নানা পথ নানা মতে বিভাজিত শিক্ষক-রাজনীতিও নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও ভাবতে হবে গুরুত্ব দিয়েই। ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষক-রাজনীতির পক্ষে সাফাই গেয়ে আমরা কী সুফল পেয়েছি এত বছরে? আরেকটি বিষয়ও ভাবার সময় এসেছে। প্রতিবাদী হওয়ার জন্য সংগঠন করা কিংবা সরাসরি রাজনৈতিক দলের প্রভাবে থাকা কখনোই অপরিহার্য শর্ত হতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ কাঁপানো দুটি আন্দোলন কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠেছিল প্রয়োজনের তাগিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

আমাদের দেশের মূলধারার রাজনীতিতে যেমন গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। অবশ্যই দায় সবার। যেমন পরিবারের দায়, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল সবার। কেউই যার যার কাজটি ঠিকমতো করিনি। আমরা আমাদের সন্তানদের নীতিনৈতিকতার শিক্ষা দিতে পারিনি। আমরা ভালো ছাত্র নামক লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার পেছনে ছুটেছি, কিন্তু ভালো ছাত্র হলেই যে ভালো মানুষ হতে পারে না, সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিইনি। তাইতো বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভালো ছাত্র হলেও ভালো মানুষ হতে পারেনি, যদিও সবার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য নয়। আমাদের সমাজে নানা দ্বন্দ্ব ও স্ববিরোধ প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। ভালো-মন্দের বিবেচনাও এখন নতুন মাত্রা লাভ করছে। আমরা ভালো কথা বলে পৃষ্ঠপোষকতা নিই খারাপের। ভালো মানুষকে এখন বুদ্ধিহীন মনে করা হয়। যেকোনো উপায় সম্পদ অর্জনকারীরা এখন সামাজিকভাবে নিন্দিত না হয়ে গ্রহণীয় হচ্ছেন, ফলে যেকোনো উপায়ে অর্থবিত্তের অধিকারী হওয়ার উৎকট প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। এগিয়ে যাওয়ার নগ্ন প্রতিযোগিতার কারণে সমাজে নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা বাড়ছে। তুচ্ছ কারণে একজন আরেকজনকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করছে না। আবরারকে যারা পিটিয়ে মারল তারা কারা? দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের মেধাবী শিক্ষার্থী কীভাবে খুনি হয়ে উঠছে, এর দায় কার বা কাদের? আমরা কেউ কি দায়মুক্ত? না মোটেও না।

ছাত্ররাজনীতির নতুন লক্ষ্য নির্ধারণের কি সময় এসেছে? পরাধীন এবং স্বাধীন দেশে কি ছাত্ররাজনীতির চরিত্র একই হবে? ছাত্ররাজনীতি হতে হবে স্বাধীন। তারা কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না। তারা ছাত্রদের নিয়ে কাজ করবে। তাহলে ছাত্ররাজনীতি আবার গৌরবের ধারায় ফিরবে। জাতির প্রয়োজনে তারাই মাঠে থাকবে। ছাত্ররাজনীতি এখন আর ছাত্ররাজনীতি নেই। তারা লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। তারা ছাত্রদের বিষয় নিয়ে কাজ করে না। তারা এখন বিত্তবান ক্ষমতাবান দলের রাজনীতি করে। মেধাবী ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতিতে নেই। আর সাধারণ ছাত্রদের রাজনীতির প্রতি এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close