আবু তাহের

  ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

কতটা প্রয়োজন ছাত্ররাজনীতির

আমাদের বোধ অনেক আগেই ভোঁতা হয়ে গেছে। এরপরই কিছু ঘটনা আমাদের নাড়িয়ে দেয়। ক্রমেই কাঁপিয়ে তোলে আমাদের মন ও মস্তিষ্ককে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যায় আমরা বাকরুদ্ধ।

ছাত্রছাত্রীরা দেশের ভবিষ্যৎÑ এটা সর্বজন স্বীকৃত কথা। আর মেধাবী ছাত্রদের কোনো তুলনা চলে না। বুয়েট সে রকমই একটি বিদ্যাপীঠ, যেখানে দেশের মেধাবীরা পড়ালেখা করেন। ছাত্ররাই দেশের কান্ডারী। তাদের কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। তারা সারা বিশ্বের মধ্যে দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। মূলত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই বলেই শিক্ষার্থীদের এত মূল্যায়ন। নিরক্ষরতা জাতিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে পরিবার তথা জাতির একটাই প্রত্যাশা, তা হলো লেখাপড়া। মূলত এ কারণেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা। বিভিন্ন ধাপে উচ্চ থেকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পান এখানে শিক্ষার্থীরা। শুধু আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই যুগ যুগ ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই সেবা দিয়ে আসছে। এর বাইরে আর কোনো লক্ষ্য তাদের নেই। এখানে শিক্ষার্থীরা আসবেন, লেখাপড়া শিখবেন, তারপর আদর্শ মানুষ হিসেবে এখান থেকে বের হবেন। আদর্শ মানুষ হিসেবে তারা তখন দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত হবেন। মূলত এটাই সার্কেল। তাহলে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা কোথায়!

মূলত ছাত্ররাজনীতি বলতে কী বোঝায়? তরুণরা শক্তি, তরুণরাই সর্বজেয়, তারা দুর্বার। সব কিছু ভেঙে নতুন করে গড়ার নামই তারুণ্য। এই জীর্ণ সমাজকে ভেঙে, কুসংস্কারকে উড়িয়ে সভ্যতার পতাকা ওড়াবেÑ এটাই তারুণ্যের ধর্ম। আর তাই যুগ যুগ ধরে দেশ ও সমাজব্যবস্থা সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এই তরুণরাই রেখেছেন। স্বাধীন বাংলার স্বপ্নবীজ সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। কী হয়েছিল সেদিন? কারো অজানা নেই। দুঃশাসনের শৃঙ্খল ভেঙে রাজপথে সেদিন নেমেছিলেন এই ছাত্ররাই। অপরাজেয় সেই শক্তি কারো রক্তচক্ষুকে ভয় করেননি। বুকের রক্ত বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করেননি এতটুকু। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। এই যে বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তারা রচনা করলেন, তা কী রাজনীতি করতেন, ছাত্ররাজনীতি? মূলত কোনো কোনো দলের পক্ষ হয়ে রাজনীতি করতেন সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত? কিন্তু দেশ, জাতি ও আমাদের অধিকারের এই পথচলা যে রচনা হয়ে গেল তাতো এই শিক্ষার্থীদের দ্বারাই হয়ে গেল। কোন রাজনৈতিক মাধ্যম? শিক্ষার্থীদের কাছে জাতির এই প্রত্যাশাই তো। বায়ান্ন থেকে একাত্তর। দীর্ঘ এই সময়ে কত উত্থানপতন। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশ। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কাদের? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান থেকে শুরু করে ছাত্রনেতারা কীসের জন্য অকাতরে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন? যদিও তাদের ছাত্রনেতা বলা হয়, একটা দলের আওতায় তারা আন্দোলন করে গেছেন, কিন্তু তা কীসের জন্য? স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য। একটা সার্বভৌমত্বের জন্য, অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে। আর এটাই তো ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রত্যাশা।

বায়ান্ন থেকে একাত্তর তারপরের কিছু সময়, এই দীর্ঘ সময়ে কম ইতিহাস রচনা হয়নি এই ছাত্রদের দ্বারা। বিনিময় যে এত তার ঋণ শোধ করা কোনো দিন সম্ভব নয়। কিন্তু এটাকে কোনোভাবেই ছাত্ররাজনীতি বলা চলে না। দেশ ও জাতির সংকটাময় অবস্থায় কান্ডারী হিসেবে শিক্ষিত এই তরুণরা আসবেনÑ এটাই তো স্বাভাবিক এবং তারা তা করেও দেখিয়েছেন। পরবর্তীতে অনেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন আর এটাও ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। শিক্ষা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর স্বাভাবিকভাবেই একজন ব্যক্তিকে দেশ ও জাতির প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিজীবন ও পরিবার নিয়ে থাকেন। কিন্তু সবাই এ রকম নন। তাহলে তো সব কিছু বন্ধ হয়ে যেত। আর তাই কেউ কেউ সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় কেউ কেউ দেশ পরিচালনায় এগিয়ে এসেছেন। সবার যোগ্যতা ও মেধাও এক নয়। আর রাষ্ট্র পরিচালনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়। যা সবার পক্ষে সম্ভবও নয়। আর এটাও একটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু ছাত্র অবস্থায় একজন ছাত্রের কাছে কী প্রত্যাশা? দেশ পরিচালনা!

দুই দশক ধরে এই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকেই এখানে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবেন, তাই পর্যালোচনা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। গত দুই দশক ছাত্ররাজনীতি থেকে আমরা কী পেয়েছি? বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি বলতে কী বোঝায়? একটি দলের ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত ছাত্রছাত্রীরা। যারা দলের হয়ে কাজ করেন, দেশের হয়ে নয়। দীর্ঘদিন ধরে এটাই একটা সিস্টেম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আর দলও তাদের ব্যবহার করে সুবিধামতো। শিক্ষা ক্ষেত্রে অরাজকতা, অস্থিরতা থেকে শুরু করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা এদের নিত্যদিনের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো দখল করে তারা রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালায়। এগুলো অনেক পুরোনো কথা। তাদের পড়ালেখার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হলেও ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল। ইচ্ছা করেই এরা বছরের পর বছর পরীক্ষায় ফেল করে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এদের পড়ালেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না। বরং এদের কারণে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর স্বাভাবিক লেখাপড়া সারা বছরই বিঘিœত হয়।

অনেকের কাছেই ছাত্ররাজনীতির একটা প্রয়োজনীয়তা বোধ হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ডাকসুর কথা বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সংক্ষেপে : ডাকসু। ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার হলো এই ছাত্র সংসদ। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে গৌরবময় ভূমিকা রাখে এই ছাত্র সংসদ। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ডাকসু।

যদিও বর্তমান ছাত্ররাজনীতি তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার বিপরীতে এরাই নানা সমস্যা তৈরি করে রেখেছেন বিভিন্ন সেক্টরে। বর্তমানে দলের মূল শক্তি ধরা হয় এই ছাত্রদের। তারুণ্যই শক্তি। তাই হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছাত্রনেতারা বিয়েশাদি করে সন্তানের বাবা হয়ে যাওয়ার পরেও ছাত্রনেতা থেকে যাচ্ছেন। চরম লাভজনক এই পদটা কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যায় না। কিন্তু এই ছাত্ররাজনীতি থেকে কী পাচ্ছি আমরা? দেশে যে এত বড় একটা বন্যা গেল। কোথাও তো কোনো ত্রাণতৎপরতাও চোখে পড়ল না দলীয় এই অঙ্গসংগঠনগুলো থেকে। যেখানে বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করে যাচ্ছে আপ্রাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তো বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। নৈশ স্কুল, পথশিশুদের শিক্ষার জন্য পথস্কুল, রক্ত দেওয়া-নেওয়া সংগ্রহ, বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডে তারা উৎসাহ-উদ্দীপনার সহিত সম্পৃক্ত হচ্ছে। তার বিপরীতে দলীয় অঙ্গসংগঠনগুলো কি সেবামূলক কাজ করছে? বরং নৈরাজ্য, সন্ত্রাস আর শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে অবিরত।

হ্যাঁ, যদি কেউ রাজনীতি করতেই চান, তবে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করুন। এতে সর্বোপরি দেশ ও জাতিই লাভবান হবে। কারণ শিক্ষিত, যোগ্য, মেধাবী তরুণরা যদি দেশের কান্ডারী হন, তবে অবশ্যই তা কল্যাণকর। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির কোনো ভালো দিক নেই যে এটাকে চালু রাখতে হবে। বরং শিক্ষাঙ্গনের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য, ছাত্রছাত্রীদের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করাসহ সব ধরনের অপরাধ বন্ধের জন্য আইন করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা একান্ত জরুরি। আর না হয় ছাত্ররাজনীতির ভালো দিকগুলো দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করে এটা চালু রাখার ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোকেই করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close