নিতাই চন্দ্র রায়

  ১৩ অক্টোবর, ২০১৯

পর্যালোচনা

সংকট নিরসনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও জলাবদ্ধতা সমস্যা এত প্রকট ছিল না। বাড়িঘর থেকে বৃষ্টির পানি ছোট নালা হয়ে নগরের প্রধান নালার মাধ্যমে নদ-নদী, খাল-বিলের মতো প্রাকৃতিক জলাশয়ে জমা হতো আর কিছু অংশ চুইয়ে জমা হতো ভূগর্ভে। প্রতিটি নগর ও তার আশপাশেই ছিল অসংখ্য খাল, বিল ও নদী-নালা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে নগর ও আশপাশের প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ভরাট করে আমরা নিজেরাই জলাবদ্ধতার মতো একটি ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করেছি। আমরা পানিপ্রবাহের নালাগুলোতে প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনা ফেলছি। ফেলছি পলিথিন ও প্লাস্টিকের মতো অপচনশীল পদার্থ, যা নগর জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া নগর কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে ড্রেনগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেয় না। বর্ষার সময় প্রতিটি নগরেই শুরু হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। এসব কারণে স্বল্প সময়ের ভারী বৃষ্টিতে রাস্তাগুলোয় হাঁটুসমান পানি জমে। নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি ঢোকে। পানির সঙ্গে গৃহস্থালি ও পয়োবর্জ্য মিশে দুর্গন্ধে নগর জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। যানজট ও জলাবদ্ধতার কারণে নগরবাসী সময়মতো কর্মস্থলে যেতে পারেন না। শিক্ষার্থীরা যেতে পারে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। রিকশা ও সিএনজি ভাড়া তিন-চার গুণ বেড়ে যায়। নি¤œœআয়ের মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানির একটি বড় অংশ রাস্তায় নেমে আসায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আগে বাড়িঘরে উঠান ছিল। সেখান থেকে পানি নেমে চলে যেত নালার মাধ্যমে প্রাকৃতিক জলাশয়ে। এখন ঢাকা শহরে কোনো বাড়িতে উঠান নেই। বৃষ্টির পানি ছাদ থেকে সরাসরি চলে আসে রাস্তায়। রাস্তা থেকে পানি বের হওয়ার মতো পথ না থাকায় ভয়াবহ জলজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকা শহরে যে ৫০টির অধিক খাল ছিল। সেগুলোর প্রায় সবগুলো ভরাট হয়ে গেছে। আর যে কটি অবশিষ্ট আছে সেগুলোরও মুমূর্ষু অবস্থা। তাহলে কোথায় যাবে বৃষ্টির পানি? নেদারল্যান্ডসে এক নাগাড়ে ৫-৬ ঘণ্টা বৃষ্টি হলেও শহরের কোনো রাস্তায় এক ফোঁটা পানিও জমে না। কত পরিকল্পিত তাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থা। চীনের বড় শহরগুলোতেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগরের উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে জলাবদ্ধতার কোনো সমস্যা ছিল না।

একটি শহরে ৪ থেকে ৫ মিনিট বৃষ্টির পর পাওয়া যায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পানি, যেটা সরাসরি পান করার মতো। প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া এই বৃষ্টির পানি যদি সংরক্ষণ করা যেত, তাহলে রাস্তার পানি শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কমে যেত। কমে যেত জলাবদ্ধতা ও যানজটের দুর্ভোগ। যানজটের কারণে শুধু ঢাকা শহরেই বছরে বাণিজ্যিক ক্ষতি হয় ২১ কোটি টাকারও বেশি।

বুয়েটের পানিসম্পদ ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সামনের দিনগুলোতে অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হওয়া এবং খরা প্রলম্বিত পাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই এখন থেকে এ সমস্যা সমাধানের কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। ঢাকায় শহরে পৌনে ২ কোটির বেশি লোকের বাস। তাদের পানির চাহিদা মেটাতে সিংহভাগ পানি সংগ্রহ করা হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। এতে প্রতি বছর তিন থেকে সাড়ে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। গবেষণায় দেখা গেছে, বৃষ্টির পানি থেকে মোট পানির চাহিদার ১৫ থেকে ২০ ভাগ পূরণ করা সম্ভব। সেই সঙ্গে বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ জলাবদ্ধতাজনিত সমস্যাও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। ঢাকার কাছে সভারের বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ভার্কের কার্যালয়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের সহায়তায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা। সেখানে সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া রয়েছে বৃষ্টির পানি রিচার্জ করে ভূগর্ভে পাঠানোরও ব্যবস্থা।

ঢাকার মতো জনবহুল সুপেয় পানি সংকটের শহরে বৃষ্টির পানিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ এবং বিতরণের বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন পরিবেশ প্রকৌশলীরা। তাদের মতে, ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি সাগরে পড়ে অযথা বিনষ্ট হচ্ছে। পানের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ওয়াসার কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। তবে বৃষ্টির পানিকে রিসার্চ করার বিষয়টিকে ওয়াসা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বলে জানা যায়। কৃত্রিম উপায়ে পানি ধরে রেখে ছাদের পানি পাইপের মাধ্যমে মাটির নিচে পাঠানো এবং সেই পানিই আবার খাবারের জন্য উত্তোলন করার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা একটি পাইলট প্রকল্প সম্পন্ন করেছে এবং তাতে বেশ সফলতা পাওয়া গেছে। বৃষ্টির পানিকে রিসার্চ করে পুনরায় মাটির গর্ভে পাঠানোর এই পদ্ধতি কিছু কিছু ভবনে এরই মধ্যে চালু করা হয়েছে। তবে তার সংখ্যা ও ব্যাপ্তি খুবই নগণ্য। এমনই এক প্রেক্ষাপটে বাড়ির নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক বলে মনে করেন পরিবেশ প্রকৌশলীরা। এ জন্য ভবিষ্যতে বহুতল বাড়ির নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রাজউক ২০০৮ সালের প্রচলিত মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করে ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০১৬ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। সংশোধিত বিধিমালায় বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ভূগর্ভস্থ পানি রিসার্চ করার জন্য বিধান রাখা হয়েছে। পানি সংকট মেটাতে ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বহু দেশে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের নজির রয়েছে। এ ক্ষেত্রে হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফেরও মতো প্রণোদনারও ব্যবস্থা রয়েছে অনেক দেশে।

পরিবেশ প্রতিবেশের ভারসাম্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এবং অগ্নিনির্বাপণ সহজ করার লক্ষ্যে ২০০০ সালের ১০ আগস্ট, সব সরকারি ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নির্দেশ দেওয়ার ১৯ বছর পরও তা আলোর মুখ দেখেনি। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! বাস্তবায়ন তো দূরের কথা- যারা এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন সেই গণপূর্ত অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর জানেই না যে প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের একটি নির্দেশ দিয়েছেন। তাহলে কীভাবে দূর হবে নগরের জলাবদ্ধতা ও সুপেয় পানির সংকট?

প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার একটি বড় এলাকা শুষ্ক হিসেবে পরিচিত। দেশটির উত্তরাঞ্চলের অর্ধেক এবং পূর্বাঞ্চলের পুরো অংশেই পানির ঘাটতি রয়েছে। শ্রীলঙ্কাতেও বেশ বৃষ্টিপাত হয়। তবে সব জায়গায় সমভাবে হয় না। সে জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার গ্রামাঞ্চলে পানির চাহিদা পূরণ করা হয়। ২৪ বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কাজ অব্যাহত আছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য শ্রীলঙ্কাতে ৪৫ হাজার ছোট-বড় ট্যাংক রয়েছে। এ ছাড়া পুকুর, কুয়া এবং জলাধারগুলোও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিভিন্ন হাসপাতাল এবং মন্দিরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা আছে। শ্রীলঙ্কার বহু গ্রামে বৃষ্টির পানি ছাড়া পানির বিকল্প উৎস নেই। দেশটিতে বছরে গড়ে ২ হাজার ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। আর আমাদের দেশে হয় প্রতি বছর ২ থেকে ৩ হাজার মিলিমিটার। যদি কোনো স্থানে বছরে ১ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাতও হয় এবং বাড়ির ছাদে যে পানি জমে, সেটি যদি সংরক্ষণ করা যায়, তা থেকে ১০ হাজার লিটার পানি পাওয়া যায় এবং সেই পানি একটি পরিবারের রান্না-বান্না এবং খাবার জন্য যথেষ্ট। কলম্বোর মতো বড় শহরগুলোতে পানির প্রধান সরবরাহ আসে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি থেকে। এর মধ্যে বৃষ্টির পানি একটি বড় উৎস। উত্তর আটলান্টিকের একটি ছোট দেশ বারমুডা। দেশটিতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত হয় ১ হাজার ৫০০ মিলিমিটার। সেখানে সুপেয় পানির শতকরা ৫৬ ভাগ আসে বৃষ্টির পানি থেকে। আর ঢাকা শহরের চিত্র ঠিক তার উল্টো। ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন মহানগরীতে ২৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে। এই পানির প্রায় ৮৭ শতাংশ আসে ভূগর্ভ থেকে। বাকি ১৩ ভাগ আসে পাশের নদী থেকে। নদীগুলোর পানিও দূষিত। ভূগর্ভ থেকে মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে অস্বাভাবিকভাবে পানির স্তর নিচে চলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ভূমি ধসের আশঙ্কা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে একটা সময় আসবে যখন গভীর নলকূপ খনন করেও ভূগর্ভ থেকে প্রয়োজনীয় সুপেয় পানি পাওয়া যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিতের ফলে ঢাকাসহ দেশের নগরগুলোর জলাবদ্ধতা সমস্যা আরো প্রকট এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। সুপেয় পানির অভাবে দেখা দিতে পারে নানা রকম পানিবাহিত রোগ। নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে পানি সংকটে। তাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা মাটিতে রিসার্চ করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবহার কিংবা রিসার্চ করার জন্য শহরের প্রতিটি ছাদে যদি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে দুই দিক থেকেই লাভবান হবে দেশ। প্রথমত, বর্ষার সময় নগরগুলোতে জলাবদ্ধতা কমে যাবে। নগরবাসী মুক্তি পাবে জলজট ও যানজটের অভিশাপ থেকে। দ্বিতীয়ত, সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি ব্যবহার করলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর থেকে চাপ বহুলাংশে হ্রাস পাবে। ফলে আর বিলম্ব না করে আমাদের জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করাই আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close