ইসমাইল মাহমুদ

  ১২ অক্টোবর, ২০১৯

পর্যালোচনা

প্রতি ৫ জনের ১ জন মানসিক রোগী

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজন তরুণ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। নানাভাবে বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য এবং উত্ত্যক্ততা শতকরা ৮৩ ভাগ তরুণের আত্মমর্যাদার ওপর প্রচন্ডভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হচ্ছে আত্মহনন। সুতরাং বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ‘ফার্স্ট ইমার্জিং ডিজিজ’ হিসেবে আখ্যায়িত মানসিক এ রোগ মোকাবিলায় এখনই সচেতন হতে হবে। নতুবা বিশ^ব্যাপী তরুণরা চরম বিপর্যস্তকর অবস্থায় পতিত হয়ে প্রচুর পরিমাণ মানসিক রোগাক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক রোগাক্রান্তদের সামাজিক, পারিবারিক ও পেশাগত ক্ষেত্রে অবহেলার চোখে দেখা হয়। তাদের নানাভাবে নিগৃহীত করা হয়। সমাজ মানসিক রোগীদের প্রতি চরমভাবে অবহেলা করে থাকে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে আমাদের দেশে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে নাগরিকদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ১৮ বছরের নিচে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত বিশ্বের ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ‘সিজোফ্রেনিয়া’ রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে অনেকেই সম্পূর্ণ অজ্ঞতা এবং পারিবারিক ও সামাজিক অসচেতনতার কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা পান না।

বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিটের পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের সাতটি বিভাগের ১২টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ২ হাজার ১৫৮ জন মানসিক রোগীর ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। ওই সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, গুরুতর মানসিক রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক রোগের হার শতকরা ৪২ ভাগ। ১৮ বছরের নিচে ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার’ রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক রোগের হার ৩২ শতাংশ এবং মাদকাসক্ত রোগীদের শারীরিক রোগের হার ২১ শতাংশ। মনোরোগ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বর্তমানে ফেসবুকসহ নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রায় ৯০ শতাংশই ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি তরুণ বা তরুণী। যাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষতির ঝুঁকি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি সবখানেই পরিবর্তন হচ্ছে। যার ছোঁয়ায় তরুণ-তরুণীরা অনেক বেশি প্রভাবিত হচ্ছে। আর প্রযুক্তিতে মগ্ন থাকার প্রবণতা বিশে^র প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-তরুণীর মধ্যে এক ধরনের আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এতে ক্রমেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম।

এদিকে, ক¤িপউটার ও স্মার্টফোনে তরুণদের গেম খেলার নেশাকে বিশে^র কয়েকটি দেশের প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশে^ প্রথমবারের মতো তরুণদের গেম খেলার অবাধ নেশাকে মানসিক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ওই সংস্থা। ওই সংস্থার ১১তম ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ’ (আইসিডি)-তে ‘গেমিং-ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ^ব্যাপী বিভিন্ন দুর্যোগের পর দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষকে প্রথমেই দেওয়া হয় মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা। এ সহায়তা দেওয়া হয় যেন ওই ব্যক্তি মানসিক শক্তির ওপর ভর করে মাথা থেকে দুর্যোগের বিষয়টি ঝেড়ে ফেলতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির খুন-ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, রক্তপাত ইত্যাদি দেখার পর মানসিক অস্থিরতা হতে পারে। এ থেকে জন্ম নিতে পারে মানসিক রোগ। এটি যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। নিজের পরিবারের কোনো সদস্য বা আপনজনদের মৃত্যু বা কোনো বিপদসঙ্কুল অবস্থার সংবাদেও এ রোগ হতে পারে। অথবা আকস্মিক কোনো কিছু হারালেও কোনো মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এসব মানুষের প্রয়োজন প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা। কীভাবে এ সহায়তা দেওয়া যেতেÑ এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রথমত. মৌলিক বিষয় যেমন খাবার, পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। পরে তাদের সান্ত্বনা দেওয়া এবং মানসিক সাহস জোগানো। সবশেষে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক বা সামাজিক অবস্থার যেন অবনতি না হয়; সেদিকে সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখা। প্রাথমিক মানসিক সহায়তা বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক বা সাইকোলজিস্ট দেবেন, তা কিন্তু নয়। এটি পরিবারের কোনো সদস্য, পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা সমাজের যে কেউই দিতে পারেন। এতে ওই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মনে নিজেকে পুরোপুরি অসহায় বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ননÑ এমন ধারণা সৃষ্টি হবে এবং দ্রুতই আক্রান্ত ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করবেন।

প্রাথমিক মানসিক সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কাদের হয়Ñ এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শিশু, নারী এবং যারা আগে থেকে মানসিকভাবে রোগাক্রান্ত ছিলেন কোনো ঘটনার পর তাদের প্রাথমিক মানসিক সহায়তা একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক যৌথ জরিপে দেখা যায়, আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ১ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ১০ জন, মধ্য আয়ের দেশে ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ২ দশমিক ৭ জন, অনুন্নত দেশে ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য শূন্য দশমিক শূন্য ৫ জন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। আমাদের দেশে ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য রয়েছেন শূন্য দশমিক শূন্য ৭ জন মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ। অথচ আমাদের দেশে প্রতি ১০০ জনে ১৬ দশমিক ১ জন কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। ফলে এ বিপুল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা হচ্ছে না বললেই চলে। এ থেকে উত্তরণে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্তকরণ, আরো অধিকসংখ্যক সাধারণ চিকিৎসকের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান, মেডিকেল কলেজগুলোতে চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিক রোগ চিকিৎসার কারিকুলাম আরো সম্প্রসারণ এবং স্কুলগুলোর পাঠ্যসূচিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্তকরণ অতিব জরুরি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এ ছাড়া দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি গ্রহণ এবং এসব কর্মসূচিতে ওই অঞ্চলের সমাজসচেতন ও সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং মানসিক রোগ বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের সহায়তা আবশ্যক বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

আমাদের দেশে দিন দিন মানসিক রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে দুই কোটির ওপরে মানসিক রোগাক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছেন। এ রোগের চিকিৎসায় দেশে সরকারি পর্যায়ে ‘পাবনা মানসিক হাসপাতাল’ ও ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট’ নামের মাত্র দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। তবে বিএসএমএমইউ ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালসহ কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে কিছু শয্যা রয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের মোট বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ মানসিক রোগ চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ২ কোটি মানসিক রোগীর জন্য মাত্র আড়াইশ চিকিৎসক কর্মরত আছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। বিশিষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগটির চিকিৎসা ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নার্স, টেকনিশিয়ানসহ জনবল নিয়োগ, ইউনিয়ন হেলথ সেন্টারে রোগটির প্রাথমিক ওষুধ সরবরাহ, সরকারি পর্যায়ে আরো বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও সহায়ক জনবল তৈরি করতে হবে। নতুবা আমাদের দেশে মানসিক রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। এতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন অগ্রগতি প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। এতে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close