ফয়জুন্নেসা মণি

  ১২ অক্টোবর, ২০১৯

মুক্তমত

ডিম নিয়ে বিভ্রান্তির অবসান হোক

আমাদের শরীরের প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ইত্যাদির চাহিদা মেটায় ডিম। পুষ্টিবিদদের মতে, সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত জীবনযাপনের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে ডিম খাওয়া উচিত। এ কথা হয়তো আপনারা জানেন, বডিবিল্ডার্সরা প্রতিদিন ডিম খান কারণ ডিম পুষ্টিগুণ-সমৃদ্ধ একটি খাবার। ডিমের মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড। এ ছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন এ, বি৫, বি১২, বি৬, ডি, ই, কে, ফোলেট, ফসফরাস, সেলিনিয়াম, ক্যালিয়াম ও জিংক। প্রতিটি ডিমের মধ্যে রয়েছে পাঁচ গ্রাম প্রোটিন। ডিম বেশ সস্তা, প্রোটিনের অন্যতম উৎস। ডিমে সুলভ মূল্যে উচ্চমাত্রার প্রোটিন পাওয়া যায়। পুষ্টিবিদরা বলছেন, ডিম পছন্দ করার পেছনে কেবল এর স্বাদই নয়, রয়েছে পুষ্টি গুণাগুণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ওজন নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে শরীরে দরকারি প্রোটিনের জোগান দেয় ডিম। তাছাড়া কেবল প্রোটিনই নয়, ডিমে রয়েছে ভিটামিন-৬, ভিটামিন-১২, ফলিক অ্যাসিড, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, থিয়ামিন, আয়রন, জিংক, ভিটামিন ডিসহ নানা প্রয়োজনীয় উপাদান। ডিম অবশ্যই একটি প্রাকৃতিক পুষ্টিকর খাদ্য, যার মধ্যে খাদ্যের সব উপাদানই বিদ্যমান। সব বয়সের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডিম অত্যন্ত কার্যকর। বিশেষ করে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, হাড় গড়নে ও মেধার বিকাশে ডিম খুবই কার্যকর। আবার মহিলাদের শারীরিক চাহিদা পূরণে এবং স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে ডিম অত্যন্ত জরুরি। অন্ত্রের ক্যানসার প্রতিরোধেও ডিম উপকারী। বিভিন্ন গবেষণা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একজন মানুষের দেহ বৃদ্ধি পায় মূলত জন্ম থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যেই এ সময় উঠতি বয়সি শিশু-কিশোরদের জন্য বয়স্ক লোকের তুলনায় অধিক পরিমাণে সুপাচ্য প্রোটিনের দরকার পড়ে। তাই এ সময়ে অবশ্যই তাদের প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়া উচিত।

মাছ-মাংসের তুলনায় ডিম হচ্ছে অধিক সুপাচ্য-সহজে হজমযোগ্য। ডিম রান্না করাও অতি সহজ। এ কারণে সব বয়সের মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় প্রতিদিনের খাদ্য হতে পারে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রতিদিন বা নিয়মিত ডিম খাওয়া যাবে কি না। এ বিষয়টি নিয়ে ডাক্তার, রোগী এমনকি সুস্থ মানুষের মাঝেও বিভ্রান্তি বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। আমরা জানি, যাদের বয়স একটু বেশি, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেনÑ এমন রোগীদের অথবা যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বা অন্যান্য চর্বির পরিমাণ বেশি, তাদের ডিম খেতে নিষেধ বা সম্পূর্ণ বর্জন করতে বলা হয়। চিকিৎসকরাও ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে শুধু সাদা অংশটুকুই খেতে বলেন। এ প্রসঙ্গে চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ স্যার। তিনি বলেছেন, সাধারণত অনেকের ধারণা ডিম খেলে রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ে, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। আসলে এত দিনের এ ধারণাটা মোটেই সত্য নয়। ডিম খেলে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা ততটা বৃদ্ধি পায় না। একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষ দৈনিক গড়ে ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত কোলেস্টেরল গ্রহণ করতে পারেন। আর একটি ডিমে রয়েছে ২০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল। তাই বিশেষজ্ঞরা এমনকি আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এখন আর তাদের খাদ্যের গাইডলাইনে ডিম খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করছেন না। তিনি পরিষ্কার করে বলেন, ডিমের সাদা অংশ খেলে কোনো সমস্যা তো হবেই না, এমনকি কুসুমসহ সম্পূর্ণ ডিম খেলেও উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হৃদরোগের ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

চীনে বিজ্ঞানীরা প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, প্রতিদিন একটা করে ডিম খেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমতে পারে। এ খবর শুনে হয়তো অনেকে পিলে চমকে যাবেন। একসময় বলা হতো বেশি ডিম খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর, বিজ্ঞানীরা এখন সে মতবাদ থেকে দূরে সরে এসেছেন। ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিটা ফরুহি বলেছেন, প্রতিদিন একটা ডিম স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তিনি বলেছেন, প্রতিদিন একটা ডিম খেলে তার থেকে হৃদযন্ত্র বা শরীরের রক্ত সঞ্চালনে কোনো ঝুঁকি তৈরি হয় না। তাই ডিম নিয়ে অনাহুত ভীতি থাকা উচিশ নয় আর উন্নত দেশে বহু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিদিন ডিম খেলে দেহের ওজন কমে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ডিমেই আছে দেহের ক্ষয়রোধে এবং গঠনে প্রতিদিনের দরকারি অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং দেহের তাপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ট চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড ও রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকার জন্য বিভিন্ন অর্গানিক খনিজ উপাদান ও ভিটামিন।

আশার খবর হচ্ছে, ডিম নিয়ে বিভ্রান্তির খবর অতিমাত্রায় প্রচারিত হলেও মানুষের মাঝে ডিমভীতির চেয়ে ডিমপ্রীতিটাই বেশি বাড়ছে। ডিম সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি কাটাতে পারলে পণ্যটির জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে বৈকি। ডিমকে ‘পাওয়ার হাউস অব নিউট্রিশন’ বলা হয়। এর অর্থ ডিম হলো পুষ্টিশক্তির ঘর। পুষ্টিবিজ্ঞানের ভাষায়, প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে ডিম হলো আদর্শ প্রোটিন। কারণ সব ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। ডিমের কুসুমে কোলেস্টেরল আছেÑ এমন ‘বদনাম’ বহুল প্রচলিত। অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, একটি ডিমের কুসুমে মাত্র ১০০-৩০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল থাকে, যেটুকু শরীরের ভালো কোলেস্টেরল তৈরিতেও কাজে লাগে। আর ডিমের সাদা অংশে কোনো কোলেস্টেরল থাকে না। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা বলেছে, কোলেস্টেরল বিষয়ে নতুন যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, তার আলোকে সপ্তাহে তিনটির বেশি ডিম না খাওয়ার যে পরামর্শ তারা ২০০৭ সালে দিয়েছিল, তা তারা তুলে নিয়েছে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে বলা হয়, দিনে একটি ডিম হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়। সকালের নাশতায় বরং একটি ডিম কোলেস্টেরল প্রোফাইলের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না, যতটা প্রভাব ফেলে আপনার সকালের নাশতায় মিষ্টি বা চর্বিজাতীয় খাবার খেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে ডিমের কোলেস্টরেলের সঙ্গে হৃদরোগের কোনো সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ডিম হৃদরোগীদের শত্রুÑ এমন মতবাদও বহুল প্রচারিত। অথচ ডিম শুধু আদর্শ প্রোটিনই নয়, বরং অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এতে রয়েছে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। এটি হৃদরোগের বিরুদ্ধে অনেক কার্যকরী। ডিম একটি পরিপূর্ণ বা ব্যালান্স ফুড। ডিমের ভেতর যে কুসুম অথবা সাদা অংশ থাকে, তার পুরোটাই সুপাচ্য প্রোটিন; যা সহজে হজম হয়। ব্রিটিশ ডায়েটিক অ্যাসোসিয়েশনের ড. ফ্র্যাঙ্কি ফিলিপস ডিম সম্পর্কে বলেছেন, ‘দিনে একটাÑ এমনকি দুটো ডিমও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। বেশি ডিম খাওয়ায় ভয়ের কোনো কারণ নেই।’ একটু ভেবে দেখুন, প্রোটিনের উৎস হিসেবে আমরা প্রতিদিন কী কী খাই। মাছ মাংস ডালই প্রধান, কিন্তু এসব প্রোটিনের উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন বা পেপটাইড শতভাগ হজমযোগ্য নয় অর্থাৎ ডাইজেস্টিবিলিটি হার অনেক কম। তার মানে যেগুলো হজম হয় না, তা মলমূত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়।

সবশেষে আমাদের জানা দরকার ডিম কীভাবে রান্না করা উচিত? ডিম রান্নার ব্যাপারে সবচেয়ে সহজ, পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত হলো ডিম সিদ্ধ করা বা পানিতে ডিম পোচ করা। বেশির ভাগ পুষ্টিবিদ ডিম ভাজা করে না খাবার পরামর্শ দেন। কারণ ডিম যে তেলে বা মাখনজাতীয় চর্বিতে ভাজা হয়, তার মধ্যকার স্যাচুরেটেড ফ্যাট কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। জীবাণু সংক্রমণের ব্যাপারে উদ্বেগ থাকলে ডিম রান্না করে খাওয়াই নিরাপদ। এবার জানা যাক, কীভাবে ডিম মজুদ রাখা উচিত। বিবিসির খাদ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ডিম ফ্রিজে রাখুনÑ ডিম রাখার

বিশেষ যে বাক্স ফ্রিজে থাকে সেখানে ডিম সবচেয়ে ভালো থাকে। বাক্সের ভেতরে থাকলে ডিমের সাদা অংশ তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে। কিন্তু ডিমের কুসুম ভালো থাকে তিন দিন। বরফে হিমায়িত অবস্থায় ডিমের সাদা ও কুসুম ভালো থাকে তিন মাস পর্যন্ত।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close