ইসমাইল মাহমুদ

  ১১ অক্টোবর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

স্তন ক্যানসার ও প্রতিরোধ

বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ১৫ লাখের বেশি নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আর প্রতি লাখে স্তন ক্যানসারে মারা যান ১৫ জন নারী। আমাদের দেশে প্রতি বছর স্তন ক্যানসারে ঠিক কতজন নারী আক্রান্ত হন তার প্রাতিষ্ঠানিক রেকর্ড করা হয় না। এমনকি করা হয় না মৃত্যুর রেকর্ডও। তবে বেসরকারি হিসাবে দেখা গেছে, আমাদের দেশে যতজন স্তন ক্যানসার আক্রান্ত রোগী আছেন তার সঙ্গে প্রতি বছর নতুন করে যোগ হয় বা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন আরো প্রায় ৩০ হাজার নারী।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১৫ লক্ষাধিক নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আর মারা যান প্রতি লাখে ১৫ জন নারী। সেই হিসাবে প্রতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৫ জনে। প্রতি বছর এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওই সংস্থার তথ্য মতে, নারী-পুরুষ উভয়ই স্তন ক্যানসারের চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর এই ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম উপায় হলো স্তন ক্যানসার সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা।

উন্নত বিশ্বে অধিকাংশ নারী ৫০ বছরের কাছাকাছি বয়সে উপনীত হয়ে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। অপরদিকে আমাদের দেশে শতকরা ৪০ শতাংশের বেশি নারী ৫০ বছর বয়সে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আর এর আগেই আক্রান্ত হন ৬০ শতাংশ নারী। উন্নত বিশে^ স্তন ক্যানসার সম্পর্কে নারীরা অধিক সচেতন থাকায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বা প্রাথমিক পর্যায়েই তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং চিকিৎসা গ্রহণ করেন। ফলে স্তন ক্যানসারে তাদের মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। অপরদিকে আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী একেবারে শেষ পর্যায়ে (ফোর্থ স্টেজ) এসে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এ অবস্থায় রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা বা সুস্থ করে তোলা অধিকাংশ সময় কোনোভাবেই সম্ভবপর হয় না। ফলে আমাদের দেশে স্তন ক্যানসারে মৃত্যুর হার অধিক। আমাদের দেশের নারীদের শেষ পর্যায়ে এসে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, স্তন ক্যানসার স¤পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে অনেকেই রোগটি বুঝতে পারেন না। আর যারা রোগটি সম্পর্কে ধারণা রাখেন তাদের অধিকাংশই সামাজিক, ধর্মীয় এবং লোকলজ্জার কারণে এ রোগটির তথ্য চেপে যান। আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ১৯৭২ সালে ছিল ৪৭ বছর। আর ৪৭ বছর পর বর্তমানে গড় আয়ু বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ৭৫ বছরে। গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। ফলে আমাদের দেশে স্তন ক্যানসার আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্তন ক্যানসার কেন হয় এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস হওয়ার কারণে আমাদের দেশের নারীদের গড় আয়ু বেড়েছে। আর চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া স্তন ক্যানসার হবার যেসব কারণ বিশেষজ্ঞরা উদ্ভাবন করেছেন তা হলো- (১) কোনো নারীর মায়ের স্তন ক্যানসার থাকলে সন্তানের অর্থাৎ ওই নারীর স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। খালার স্তন ক্যানসার থাকলে বোনের মেয়ের এ রোগ হতে পারে। অর্থাৎ স্তন ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। (২) যে নারীদের সন্তান হয় না তাদের বা অধিক বয়সি অবিবাহিতা নারীদের স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। (৩) যেসব মায়েরা তাদের সন্তানদের কখনোই বুকের দুধ খাওয়াননি অথবা অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে খাওয়াতে পারেননি সেসব মায়েদের স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। (৪) যেসব নারী তার বয়স ৩০ বছর অতিক্রম করার পর প্রথমবারের মতো মা হয়েছেন তাদের স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। (৫) যে নারীদের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কম বয়সে মাসিক শুরু হয় এবং বয়সের দিক থেকে অনেক দেরিতে মাসিক বন্ধ হয় সে সব নারীরা আছেন স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিতে। (৬) কোনো নারী যদি একনাগারে ১০ বছরের অধিক সময় ধরে জন্ম নিরোধক ট্যাবলেট বা বড়ি খান ওই নারীর স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

উপরোক্ত কারণগুলো স্তন ক্যানসার হওয়ার জন্য একক কোনো কারণ নয়। ওপরের যে কোনো একটি বা একাধিক কারণে নারীদের স্তন ক্যানসার হতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি। তাই যত বয়স বাড়বে ততোই সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে নারীদের বয়স ৩০ বছর অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই স্তন ক্যানসার সম্পর্কে সতর্ক হয়ে চলতে হবে।

নারীদের স্তন ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো নিয়ে ধারণা দিয়েছেন বিশেজ্ঞরা। স্তন ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো- (১) স্তনে তীব্র বা মাঝারি মানের ব্যথা অনুভব হওয়া। (২) স্তনের বোটা থেকে কিছু বের হওয়া। (৩) স্তনের ভেতর চাকা (ষঁসঢ়) অনুভব করা। (৪) স্তনের আকার পরিবর্তন হওয়া। (৫) স্তনের ত্বকে ঘা জাতীয় রোগ দেখা দেওয়া। (৬) স্তনের ত্বকে লালচে ভাব বা লালচে দাগ দেখা দেওয়া।

ওপরের লক্ষণগুলোর কোনো একটি বা একাধিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে চিকিৎসা শুরু করা আবশ্যক।

বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন তাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটা কম হয়। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করতে পারলে অনেক সময় এ রোগে আক্রান্ত রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়। আসুন স্তন ক্যানসার সম্পর্কে নিজে সচেতন হই, অন্যকে সচেতন করি। নিজে বাঁচি, অন্যকে বাঁচাই।

লেখক : গণমাধ্যকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close