ইয়াসমীন রীমা

  ১১ অক্টোবর, ২০১৯

মন্তব্য

দুর্যোগের তথ্য জানা বোঝার প্রযুক্তি

বজ্রঘাত শব্দের লাতিন রূপ হচ্ছে ‘টোনার’। আর টোনার শব্দটি স্প্যানিশ রূপ ‘ত্রোনাদা’ যার মানে বজ্রগর্ভ ঝড়। অতঃপর ইংরেজি রূপ টনের্ডো। গত কয়েক বছর আগে ‘সিডর, আইলা’ শব্দটি ছিল অপরিচিত। বর্তমানে এসব ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কেবল পরিচয় নয় ভয়ংকর ছোবলের চিহ্ন নিয়ে বয়ে বেড়াবে আরো দীর্ঘদিন। বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উত্তরে হিমালয় এবং সমুদ্র উপকূল ফানেল বা চোঙাকৃতির হওয়ার জন্য এদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পতিত হয়।

বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তর ব-দ্বীপ। বন্যা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙন, ভূমিকম্প নিত্য সহচর। গত শত বছরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। প্রতি বছর এপ্রিল-মে (চৈত্র-বৈশাখ) মাসে টর্নেডোর প্রকোপ দেখা যায়। বাংলাদেশে এটি ঘূর্ণিঝড় বা কালবৈশাখী নামে বহুল পরিচিত। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টর্নেডোর আঘাতে ৩৩ জনের অধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছে সহস্রাধিক মানুষ। দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে শত শত ঘরবাড়ি, স্কুল, মাদ্রাসা বিভিন্ন ভবন ও গাছপালা। সাধারণত টর্নেডো প্রচন্ড গতিতে ঘুরতে থাকা বাতাসকে বোঝানো হয়ে থাকে। তবে এই প্রচন্ডগতিতে ঘূর্ণায়নমান বাতাসকে টর্নেডো হতে গেলে তাকে অবশ্যই ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। টর্নেডোর আকার-আকৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক ফানেলের আকৃতিতে দেখা যায়। বেশির ভাগ টর্নেডোয় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ মাইলের কম থাকে। সাধারণত কয়েক মাইল যাওয়ার পরই এসব টর্নেডো শক্তির হ্রাস হয়। কিন্তু একটি শক্তিশালী টর্নেডোতে বাতাসের গতিবেগ ৩০০ মাইল হতে পারে। এই ধরনের শক্তিশালী টর্নেডো ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকাজুড়ে তান্ডব চালায়। সব সময়ই টর্নেডো একদিকে ঘোরে অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে। টর্নেডোর ধ্বংস ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে জাপানি ও আমেরিকান বিজ্ঞানী এ স্কেল উদ্ভাবন করেন। তার নামের সঙ্গে মিল রেখে এ স্কেলের নাম রাখা হয় ফুজিতা স্কেল। ফুজিতা স্কেলের উন্নত সংস্করণটি বর্ধিত ফুজিতা স্কেল নামে পরিচিত। এ স্কেল অনুসারে সেসব টর্নেডো শুধু গাছপালা ধ্বংস করে এগুলো ইএফও টর্নেডো। আর দালানকোঠা উপড়ে ফেলতে সক্ষম তাহলে ইএফ৫ জাতীয় টর্নেডো। যখন শীতল আর শুকনো বাতাসের সঙ্গে সিক্ত আর উত্তপ্ত বাতাসের সংঘর্ষ বাঁধে তখন এমন এক মারাত্মক ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হয় যাকে বলে। ‘মেসোসাইক্লোন’ পরিবেশ অনুকূলে এলে মেসোসাইক্লোনের নিচে জমা হতে থাকে ‘ওয়াল ক্লাউড’ নামের মেঘ। আর এই ওয়াল ক্লাউডের নিচেই ব্যাপক গতি ও ক্ষমতা নিয়ে ফুঁসতে থাকে টর্নেডোর ঘূর্ণিপাক। অনেক সময় লক্ষ করা যায় একটিমাত্র টর্নেডো থেকে অনেক টর্নেডোর সৃষ্টি হয়েছে। কিংবা পুরোনো ঝড়টি নতুন ঝড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তাকে আরো শক্তিশালী করে তুলছে। এ ধরণের টর্নেডোকে বলে টর্নেডো পরিবার। আবার কখনো দেখা যায় একটি বড় মাত্রার ঝড় থেকে অনেক টর্নেডোর সৃষ্টি হয়েছে। যদি কোনো রকম বিরতিহীন এ রকম একের পর এক টর্নেডো সৃষ্টি হতে থাকে তাহলে তাকে বলে ‘টর্নেডো মড়ক’। টর্নেডোর আকার বা স্থায়িত্ব দিয়ে এক ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায় না। অধিক জায়গা নিয়েও টর্নেডো কম ক্ষতিকর হতে পারে বিপরীত অল্প জায়গা নিয়েও হতে পারে মারাত্মক, ভয়ংকর ইতিহাস উত্তীর্ণ। আবহাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তা আয়েশা খাতুন জানান, আবহাওয়ার অনেক কিছুর মতো টর্নেডো এখনো ভালো করে বুঝে ওঠতে পারেনি বিজ্ঞানীরা। সুনামি, ভূমিকম্পেরও আগাম সংকেত দেয়া যায় না। শক্তিশালী রাডার টর্নেডো ধরতে পারলেও প্রচার করতে করতেই তো টনের্ডো হামলে পড়বে। এখন টর্নেডোর ক্ষয়ক্ষতি মাপা হয় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত হলো তা দেখে। এই টর্নেডোর কোনোরূপ আগাম সংবাদ দেয়ার প্রযুক্তি বাংলাদেশে নেই। স্থানীয়ভাবে এত অল্পসময়ে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তা পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়। কেবল ঘটে যাওয়ার পরই জানা যায়। তবে পালস-ডপলার নামে একটি রাডারের সাহায্যে টর্নেডোর পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। ঝড় পূর্বাভাস কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ এস এম কামরুল হাসান বলেন, প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, টর্নেডোটি ঊর্ধ্বাকাশের ১৫-২০ কিলোমিটার ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। টনের্ডো যখন ভূমিতে আঘাত করে তখন তা চোখের পলকে একের পর এক জনপদ ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ২২ মার্চ ২০১৩ সালের আঘাত হানা ভয়াবহ টর্নেডো চিত্রটি প্রথম পাওয়া গেল।

বাংলাদেশে স্পারসো (বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেনসিং অরগানাইজেশন) আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এসব তথ্য সংগ্রহ করে। স্পারসোর এক তথ্য বিবরণীতে ১৮৯১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ১৭৪টি বড় ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। ১৯৮০ সালের আগে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় শনাক্তকরণের যন্ত্র বা প্রতিষ্ঠান ছিল না। সে বছরই প্রথম স্পারসো গঠন করা হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যত ঘূর্ণিঝড় গেল সব স্পারসো পর্যবেক্ষণ করেছে। দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) ব্যবহার করে স্পারসো। কৃত্রিম উপগ্রহদ্বয়ের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র্যের নোয়া, যাতে দুই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে জিওস্টেশনারি (মহাকাশে স্থির অবস্থায় থাকে) ও পোলার অরবিটিং (ঘূর্ণায়ন) কৃত্রিম উপগ্রহ। জিওস্টেশনারি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবী থেকে ২২ হাজার ২৪০ মাইল এবং পোলার অরবিটিং স্যাটেলাইট ৫৪০ মাইল দূরে অবস্থান করে। নোয়া স্যাটেলাইট থেকে স্পারসো প্রতিদিন দুটি করে স্যাটেলাইট ছবি পায়। অপর স্যাটেলাইটটি হচ্ছে এফওয়াইটুসি। আবহাওয়াবিষয়ক কৃত্রিম উপগ্রহ। এই দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহারের ফলে ৮ থেকে ১০ মাইল দূরের ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। স্পারসো ১২ নভেম্বর ২০০৭ থেকেই সিডরের ওপর নজর রেখেছিল। প্রতি ঘণ্টায় সিডরের অবস্থান ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে জানানো হচ্ছিল। আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকার ফলে অন্য বারের ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল কাদের বলেন, বর্তমানে স্পারসো যে দুটি স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে তা দিয়ে অনেক আগে থেকে যেকোনো ঘূর্ণিঝড় শনাক্ত করা যাবে। তাছাড়া নোয়ার মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও তথ্য জানা যায়। তবে এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আকাশ মেঘলা থাকলে নোয়া ছবি তৈরি করতে অক্ষম। কারণ এ ধরনের স্যাটেলাইট অনেকটা ক্যামেরার মতো কাজ করে থাকে। আলোর প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে ছবি তৈরি করে, এজন্য সূর্যের আলোর প্রয়োজন হয়। এ সমস্যার সমাধান করা যায় যদি মাইক্রোওয়েভ স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। স্পারসো এ ধরনের কোনো স্যাটেলাইট নেই। এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ স্টেশন ব্যবহারের জন্য পৃৃথক করে ভূমিতে অবস্থিত স্টেশনের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে এমন স্যাটেলাইটের একটি গ্রাউন্ড স্টেশন বসানো হলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তথ্য আরো সঠিকভাবে জানা যাবে বলে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনটি আলাদা দফতর আছে। ওয়েবসাইটের এজেন্সি শিরোনামের বোতামে ক্লিক করলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো (www.dmb.gov.bd) ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদফতর (www.drr.gov.bd) এবং খাদ্য অধিদফতর (www.dgfood.gov.bd) দফতরগুলোর মধ্যে যেকোনোটি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য ওই নির্দিষ্ট দফতরের ওয়েবসাইটে পিডিএফ ফাইল আকারে থাকায় নিজস্ব কম্পিউটারে সেভ করে রাখা যায়। তবে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের (www.mofdm.gov.bd) ওয়েবসাইটের তথ্যগুলো ইংরেজিতে থাকায় ইংরেজি না জানা মানুষের কাজে লাগবে না। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অভাবী ও দুঃখী মানুষের জন্য ত্রাণ খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের ডানপাশে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে লেখা রয়েছে। এ বিভাগে সরকারের ‘ত্রাণ’ বিতরণ নীতিমালাটি প্রকাশ করা হয়েছে। যে কেউ প্রয়োজনবোধে মাউস নিয়ে ক্লিক করলে নতুন পাতায় ত্রাণ বিতরণ নীতিমালা-২০০৭ পাওয়া যাবে। যার অধীনে রয়েছে আটটি ফাইল। বাংলায় লেখা এই নীতিমালা থেকে জানা যাবে সরকার কালবৈশাখী, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকান্ড, বন্যা, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, সড়ক দুঘর্টনা, লঞ্চ, ট্রলারডুবি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিক সাহায্য হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মঞ্জুরি দেয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গৃহ বাবদ নগদ অর্থ, সাধারণ ত্রাণের চাল ও খাদ্যশস্য, কম্বল, চাদর, শীতবস্ত্র, ঢেউটিন ইত্যাদি সাহায্য দেয়।

যদিও বৈশাখ নববর্ষের বারতা নিয়ে আসে তবে তার মাতাল হাওয়ার তোড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় হাজারো মানুষের স্বপ্নগুলো, আশাগুলো। গত ২২ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিনটি গ্রামের ওপর দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিট স্থায়ী ভয়াবহ টর্নেডো বা ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা নিয়ে আখউড়া আমোদাবাদ দীঘি গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মোতাহের আলী বলেন, জীবনে এমন ঘটনা দেখেনি। চোখের পলকেই সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেল। এ যেন বিস্ময় ব্যাপার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা রেশ না মিলাতেই ২৮ মার্চ নাটোর জেলার পত্নীতলায় টর্নেডো আঘাত হানে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, চলতি বছরের মে মাসের দিকে আরেকটি ভয়াবহ টর্নেডোর মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close