মাহবুবুল আলম

  ১১ অক্টোবর, ২০১৯

মতামত

অর্জনকে সুসংহত করতে চাই কঠোর পদক্ষেপ

২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ঘোষিত ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারের ২১টি বিশেষ অঙ্গীকারের মধ্যে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছিল। ইশতেহার ঘোষণাকালে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি নিজে এবং দলের পক্ষ থেকে আমাদের যদি কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসী আপনাদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি কথা দিচ্ছি, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আরো সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব।’ তিনি আরো বলেছিলেন, “প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার অনুসারে টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য দরকার ‘স্বচ্ছ প্রশাসন’। আর সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সমৃদ্ধির সব সুযোগ এবং সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে তখনই, যখন জবাবদিহিমূলক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এজন্য ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ : এই উপশিরোনামে বলা হয়েছেÑ ‘দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে। আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও তদারকি ভবিষ্যতে আরো জোরদার করা হবে।”

এ ইশতেহারে ঘোষিত অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই গত সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে সারা বিশ^কে তাক লাগিয়ে তিনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমৃদ্ধ দেশের কাতারে। বাংলাদেশের মর্যাদাকে উন্নীত করেছেন অনন্য উচ্চতায়। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখন আটের ঘর পেরিয়ে দুই ডিজিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারের সীমা ছাড়িয়েছে ইতোমধ্যে। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অভূতপূর্ব উন্নতিতে সারা বিশে^র দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু দেশের এ সুনাম ও অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে বসেছে দুর্নীতির দুষ্টচক্র, নতুনভাবে উদ্ভব হওয়া দুর্নীতির দানবেরা। বিপুল টাকার বিনিময়ে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ নেতার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফ্রিডম পার্টি, জামায়াত-শিবির, বিএনপি এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের তল্পিবাহক মোসাহেবরা মুখোশ পাল্টিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। আর এই অনুপ্রবেশকারী নব্য নেতাদের দাপটে দলটির প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী নেতারা পদ-পদবি বঞ্চিত হয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু দলে অনুপ্রবেশকারী কাউয়া নেতারা কীভাবে মাত্র কয়েক বছরে দুর্নীতি ও অবাধ লুটপাটের মাধ্যমে আঙুলফুলে বটগাছে রূপান্তরিত হয়েছে, তার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে।

শুধু তাই নয়, এ সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমনকি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও তোলা হচ্ছে এ ধরনের অভিযোগ। দেশে দুর্নীতি কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এ থেকে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। বস্তুত দুর্নীতি এখন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সমস্যা। রাজনীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বত্রই বিস্তার ঘটেছে দুর্নীতির। বলা যায়, ঘুষ বা অবৈধ লেনদেন ছাড়া কোথাও কোনো কাজ হয় না। দুর্নীতির বৈশ্বিক ধারণাসূচকে বছর বছর এর প্রতিফলন ঘটছে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গ্লানিকর। দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। কারণ এর ফলে আয়বৈষম্য বাড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রী অতি সম্প্রতি বলেছেন, দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। বস্তুত এ মুহূর্তে বাংলাদেশ যেখানে অবস্থান করছে, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা গেলে অতি দ্রুত সেই অবস্থান আরো অনেক উপরে ওঠা যেত।

দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যোগ হতে পারছে না। এই হিসাব অবশ্য রক্ষণশীলভাবে করা। জিডিপির চলতি মূল্যকে ভিত্তি ধরে হিসাব করলে বছরে অঙ্কটা দাঁড়াবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্নীতি রোধ করা গেলে প্রতি বছর দেশের জিডিপি ২ শতাংশ বাড়বে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি ছিল চলতি মূল্যে ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা এবং স্থিরমূল্যে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি ধরা হয়েছে ১৯ লাখ ৬১ হাজার ১৭ কোটি টাকা। চলতি মূল্যে ২ শতাংশ হিসাবে দাঁড়াবে ৩৯ হাজার ২২০ কোটি টাকা। জিডিপির পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। পাঁচ বছরের জন্য রক্ষণশীল হিসাব করলে দুর্নীতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৮০ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকারি কেনাকাটা, জনবল নিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রকোপ থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর তদারক ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ঋণদাতা গোষ্ঠীর স্থানীয় পরামর্শক দলের (এলসিজি) সঙ্গে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় দুর্নীতির কারণে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ নষ্ট হয় বলে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই পরিমাণের কথা বলেছিলেন তিনি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপনের সময়ও। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা তথ্যমতে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, বিচার এসব সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অর্থের দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো হবে। আর সরকারি বড় বড় কেনাকাটায় যোগসাজশের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ হবে জিডিপির ৩ শতাংশের মতো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দুর্নীতির আকার দাঁড়াবে জিডিপির ৫ শতাংশ।

সরকারি কেনাকেটা, জনবল নিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর তদারক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয় দুদক চেয়ারম্যানের পাঠানো এক চিঠিতে। এতে তিনি বলেছেন, দুর্নীতি কমাতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো উদ্যোগ নিলে দুদক সহযোগিতা করতে একান্তভাবে আগ্রহী। পত্রে সরকারি দফতরে দুর্নীতির ‘ধূসর ক্ষেত্র’ চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়ে ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি রোধ করা গেলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান গতিশীল হবে, দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমবে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই যুদ্ধকে শেখ হাসিনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার শাসনামলে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘... সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সবাইকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’ শেখ হাসিনাও তার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সব কাজে আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র নিষ্ঠার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

ভাবতেই অবাক লাগে কট্টর বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়ার দেহরক্ষী, বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরকারী লোকমানকে আওয়ামী লীগের ১০ বছরে ক্ষমতাধরই করা হয়নি, অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যের কালোটাকার মালিক বানিয়ে বিপুল অর্থ-সম্পদ ও বিদেশে অর্থ পাচার করতে দেওয়া হয়েছে। বিসিবির দাপুটে পরিচালক করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনির আপন ভগ্নিপতিকেও সে হাত ধরে বিসিবির পরিচালক বানিয়েছে! ক্রিকেট মাঠে প্রধানমন্ত্রীর বক্সে তারাও পেছনে বসে খেলা দেখেছে। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জি কে শামীমকে আওয়ামী যুবলীগে পদ-পদবি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সুযোগ করে দিয়েছে আওয়ামী যুবলীগেরই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। জি কে শামীমকে যুবদল থেকে যুবলীগে এনে সরকারি সব ভবন নির্মাণের একচ্ছত্র ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী যেখানেই উদ্বোধনে গেছেন; সেখানেই মাফিয়া ডন শামীম ছবি তুলতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রীসহ ওপর মহলের সঙ্গে। বিপুল অর্থ ও সম্পদ আর ভোগের সাম্রাজ্য পায় জি কে শামীম। এই অসৎ নেতাদের হাত ধরে কোটি টাকা উৎকোচের বিনিময়ে যুবলীগে ঢুকিয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।

পরিশেষে অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বেইমানি করেছিল খন্দকার মোশতাক, তাহের ঠাকুররা। জাতির পিতার আপনজনরাই তাজউদ্দীনকে সরিয়ে মোশতাকদের তার পাশে ভিড়িয়েছিলেন। ৭৫ সালের কালোরাতে বঙ্গবন্ধু পরিবার-পরিজনসহ যখন বর্বর হত্যকান্ডের শিকার হন, তখন সেই আপনজনরাও রেহাই পাননি। যেমন আদর্শে বন্ধু তাজউদ্দীনরাও ক্ষমতার দূরে থেকেও কারাগারে পড়ে নিহত হন। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের বারবার যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close