সতীর্থ রহমান

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

মতামত

গৃহপরিচারিকা সংকটে বাংলাদেশ

আমাদের বাসাবাড়িতে গরিব লোকজন ও মহিলারা নানা রকম কাজকর্ম করে। এদের চাকর, গৃহকর্মী, গৃহভৃত্য, গৃহপরিচারিকা, কাজের লোক, বুয়া প্রভৃতি নামে ডাকা হয়। অভিধান মতে, চাকর শব্দের অর্থ হলো ভৃত্য ; পরিচর্যাকারী, সেবক, পরিচারক। কর্মচারী নির্দিষ্ট কর্মসম্পাদনের জন্য নিযুক্ত বেতনভোগী ব্যক্তি। এরা সাধারণত খাদ্য ও অর্থের বিনিময়ে মানুষের বাড়িতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে থাকেন। এদের বিশ্রামের সুযোগ থাকে কম। বেতন নামমাত্র। আজকাল কাজের বুয়ারা ছোটা কাজ করতে বেশি পছন্দ করেন। প্রতিদিন ঘণ্টা হিসেবে একাধিক বাসাবাড়িতে কাজ করে তারা অনেক বেশি আয়-রোজগার করছেন। আবাসিক কাজের মহিলা পাওয়া এখন খুব কঠিন ব্যাপার।

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এ দেশে মানুষের অভাব নেই, অভাব আছে কাজের লোকের। জনগণ এখন আর কাজ করতে চায় না। কায়িক পরিশ্রমকে মানুষ ভয় পায়। অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করাকে অনেকে ঘৃণা করেন। যুগের পরিবর্তনের ফলে মানুষের আয় বেড়ে গেছে। অল্প পরিশ্রমে মানুষ এখন বেশি আয় করতে চায়। একজন শ্রমিক এক দিন কাজ করে তিন দিন বসে খেতে পারেন। দেশে আয় অনুযায়ী ব্যয় বাড়েনি। মানুষ এখন খুব সুখী। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত হয়েছে। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে জনসাধারণ উচ্চাভিলাষী ও কর্মবিমুখ হয়ে পড়ছে। দেশে একশ্রেণির মানুষ প্রচুর কাজ করলেও অন্য আর একশ্রেণির মানুষ অলস সময় কাটাচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষরা কুড়ে, কর্মহীন ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। দেশে বিভিন্ন ধরনের ভাতা চালু হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিএফ কার্ড প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধার ফলে গরিবশ্রেণি কর্মহীন ও পরমুখাপেক্ষী হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ফলে কাজের লোক সহজে পাওয়া যায় না। সৎ, দক্ষ, বিশ্বাসী কাজের মহিলা খুঁজে পাওয়া এখন সোনার হরিণ। হতদরিদ্র, অভাবী মানুষরা চেয়ে চিন্তে খাবে; তবু মানুষের বাড়িতে কাজ করতে চায় না। তাদের ধারণা, কাজ না করে যদি খেয়ে পরে চলা যায়, তাহলে কাজ করে কী লাভ!

সমাজে নানা ধরনের কাজ আছে। মানুষ যে কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে তাকে পেশা বলে। পেশাজীবীরা বিভিন্ন উৎপাদন কাজে জড়িত, কেউ ফসল উৎপন্ন করেন আবার কেউ অন্যদের সেবা দান করেন। প্রতিটি পেশার মানুষ শ্রম দিয়ে থাকে। এই শ্রমজীবীরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে সাহায্য করেন। তাই সব ধরনের পেশাকে আমাদের মর্যাদা দিতে হবে। কাজের মহিলাদের দিন-রাত কষ্টসাধ্য কাজ করতে হয়। তাই তাদের প্রতি সদয় আচরণ করা উচিত। পৃথিবীতে কোনো কাজই তুচ্ছ নয়। কোনো কর্মী বা শ্রমিক নগণ্য নয়। প্রত্যেক কর্মী ও শ্রমিকের হাতই উত্তম হাত। শ্রমের উপার্জনই উত্তম উপার্জন। এক হিসেবে আমরা সবাই শ্রমিক। দেশের ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই শ্রম দেন এবং বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেন। তাই কোনো শ্রম বা শ্রমিককে ঘৃণা করতে নেই। প্রত্যেক শ্রমিককে তার শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। আমরা অনেক সময় কাজ করতে গেলে লজ্জা পাই। মনে করি, কাজ করলে লোকে আমাকে কাজের লোক বলবে। চাকর বলবে। ঘৃণা করবে। অসম্মান করবে। কিন্তু এ রকম মনে করা ঠিক নয়। বরং কাজ করলে সবাই তাকে ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। স্নেহ করে। মহানবী (সা.) চাকরদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘যারা কাজ করে তারা তোমাদের ভাই। তাদের কষ্ট দেবে না। মর্যাদা দেবে। নিজে যা খাবে তাদের তা খাওয়াবে। নিজে যা পরবে, তাদের তা পরাবে। কাজকর্মে তাদের সাহায্য করবে’। তিনি আরো বলেন, ‘শ্রমিককে তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক দিও’।

জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১১তম। ২০১১ সালে দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০১৫ জন। অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে মানুষ সহজে চাকরি পায় না। পরিবেশ দূষিত হয়। সমাজে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, প্রতারণা, অপরাধপ্রবণতা প্রভৃতি বেড়ে যায়। দেশে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। আর তাদের অধিকাংশ আয়মূলক কাজে জড়িত নন। ফলে ছেলেমেয়ে লালন-পালনেই তাদের বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। মেয়েদের যথাযথভাবে শিক্ষা দিলে তারা তাদের পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জনের কাজ করতে পারেন। নারী সমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে জুতসই প্রযুক্তির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ‘মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার না হলে কিছু হওয়ার জো নেই। পুরাণ, ইতিহাস, গৃহকার্য, সেলাই, শরীর পালন, রন্ধন, শিল্প, ঘরকন্নার নিয়ম ও আদর্শ চরিত্র গঠনের সহায়ক নীতিগুলো বর্তমান বিজ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্রীদের ধর্মপরায়ণ ও নীতিপরায়ণ করতে হবে। যাদের মা শিক্ষিত ও নীতিপরায়ণ হন, তাদের ঘরেই বড়লোক জন্মায়।’

এখন সময় বদলে গেছে। যুগের পরিবর্তনের ফলে চাকরি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষিত মেয়েদের চাকরি করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। চাকরিজীবী নারীরা পরিবার-পরিজন ও স্বামী-সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। চাকরিজীবী দম্পতিরা সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। সরকার চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দিলেও সন্তান লালন-পালনের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার গড়ে ওঠেনি। চাকরিজীবী দম্পতিদের সন্তান লালন-পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে কাজের মহিলার ওপর নির্ভর করেন। চাকরিজীবী নারীর কর্মস্থলে শিশুসন্তান লালন-পালনের জন্য শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র (বেবি কেয়ার কর্নার) স্থাপন করা আশু প্রয়োজন। অস্ট্রেলিয়ায় উন্নত মানের ডে কেয়ার সেন্টার আছে। সেখানে শিশুরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নিরাপদে, মাতৃস্নেহে ও আনন্দঘন পরিবেশে থাকার সুযোগ পায়।

শ্রমজীবী নারীর দিন শুরু হয় রান্নাঘর দিয়ে। বাসার সবার রান্না সেরে তবেই তাকে দৌড়াতে হয় কর্মক্ষেত্রে। ফিরে এসে ওই রান্নাঘরেই। কর্মজীবী নারীদের অনেক ধকল সইতে হয়। আমাদের দেশে গৃহবধূরা সংসারের বিভিন্ন কাজ করেন। অথচ স্ত্রী চাকরি না করলে বলা হয়, ‘কিছু করে না। খায় আর শোয়।’ এই কিছু না করার মধ্যে সন্তান জন্মদান, লালন-পালন, পড়ানো, ঘরের সচ্ছলতা বাড়াতে হাঁস-মুরগি ও গরু, ছাগল পালন, পতিত জমিতে সবজি চাষ, বাসাবাড়িতে কাজ করা, মাছ ধরা, জাল-কাঁথা সেলাই করে বিক্রি, কৃষিকাজে অংশ নেওয়া, সবজি, ফল ও ডিম বিক্রির মতো কাজও তারা করছেন। কিন্তু তাদের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ অদৃশ্যমানই থেকে যাচ্ছে। তাদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই বা পরিসংখ্যানে খানিকটা থাকলেও ওই অবদানের দৃশ্যমানতা নেই। ফলে নারীরা চাকরি না করলে কিছু করে নাÑ এমন মানসিকতা নিয়েই শিশুরা বড় হয়। তাদের মস্তিষ্কে নারীর কিছু না করার পরিচয়টি স্থায়ী হয়ে যায়। সমাজ জীবনে, সংসার জীবনেÑ সর্বক্ষেত্রে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। বিভিন্ন গবেষণায় মেহনতি নারীর কর্মঘণ্টা হিসাবের খাতায় তুলে আনার কথা ওঠে আসছে। সরকারের পক্ষ থেকে নারীর গৃহস্থালির কাজের হিসাবকে কার্যকর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাস্তবায়নে ২০১৩ সালের জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি এবং জিডিপিতে অন্তর্র্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতে উল্লিখিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা বা পদ্ধতি বাতলে দেওয়া হয়নি। নারী চাকরি করলে বলা হয়, ‘ও তো চাকরিই করে! সংসারের কিছু কি দেখে’? কিংবা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘চাকরি করে শুধু পার্লার আর অর্নামেন্টই কেনে’।

দেশে গৃহপরিচারিকা নিয়োগ, নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করা উচিত। পরিবারের সদস্যদের মতো কাজের লোকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। চাকরদের নিরাপদ বাসস্থান, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অজ্ঞতা, অশিক্ষা, উদাসীনতা, কুসংস্কার, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণে আমরা উন্নয়নের সুফল পাচ্ছি না। জীবন ঘনিষ্ঠ ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব। দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি ও প্রতিটি মানুষকে উৎপাদন ও উন্নয়নের কাজে লাগাতে পারলে সুখী, সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সফল হবে।

লেখক : শিক্ষক, স্বনির্ভর কৃষি ক্লাবের রূপকার, দিনাজপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close