মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

মতাদর্শের ময়দান কতটা ফাঁকা থাকে

বর্তমান বিশ্বে মতাদর্শিক বিরোধ বহুমাত্রিক রূপ লাভ করেছে। একসময় পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ বেশ অগ্রসরতাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে চর্চা করা হতো। এর বিপরীতে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় উদারবাদী এবং রক্ষণশীল মতাদর্শের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীসমূহ মতাদর্শিক চর্চা একাডেমিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়ে করত। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সমাজতন্ত্রের পক্ষে এবং বিপক্ষে বইপুস্তক পঠন-পাঠনের ব্যাপারে তেমন কোনো বাধানিষেধ ছিল না। তবে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক বিষয় নিয়েও অনেক লেখালেখি হতো, বিতর্কও হতো। কিছু কিছু তত্ত্ব সমাজতন্ত্রকে উড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে করা হতো। এর বাইরে বিভিন্ন ধারার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মতাদর্শ রাজনৈতিক ও একাডেমিক মহলে উদারভাবে করা হতো। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় পুঁজিবাদী মতাদর্শের একাডেমিক এবং রাজনৈতিক সমালোচনা ব্যাপকভাবে ছিল। এসব মতাদর্শিক বিতর্ক আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও ব্যাপকভাবে ছিল। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত মেধাবী এবং আদর্শিক ধ্যানধারণায় বেড়ে উঠত; তারা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের নানা ধরনের বইপুস্তক পড়াশোনা করত। আমাদের দেশে এসব বই বেশ সস্তায় পাওয়া যেত। ফলে বামপন্থার চিন্তার খোরাক হিসেবে দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে মার্কসবাদী, লেনিনবাদী, কেউ কেউ মাওবাদী বই পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। পৃথিবীজুড়ে এই মতাদর্শের দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক শক্তি ও সমূহের মধ্যে যত তীব্র হচ্ছিল; তত বেশি মতাদর্শের নানামাত্রিক দিক নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, পড়াশোনা ইত্যাদি গুরুত্ব পেয়েছিল। এর ইতিবাচক দিক ছিল যে, শিক্ষিত তরুণদের একটা বড় অংশই সমাজ প্রগতি নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ হতো, পথ খোঁজার নানা রকম বইপুস্তক, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি হাতের কাছে খুঁজে পেত।

আমাদের দেশেও ৫০, ৬০, ৭০ এবং ৮০-এর দশকে রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনে অন্যতম কাজ ছিল দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ববাস্তবতা ইত্যাদি সম্পর্কে নানা ধরনের পাঠচক্র, আলোচনা চক্র, সভা-সেমিনার, বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা ইত্যাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা। এমনকি গ্রামেগঞ্জে লাইব্রেরি ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাটকসহ সাংস্কৃতিক নানা ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান নিয়মিত হতো। আমরা যখন স্কুল-কলেজে পড়েছি; তখন এসব ধারায় নানাভাবে প্রভাবিত হওয়ার চেষ্টা করেছি। অসংখ্য ছেলেমেয়েকে দেখেছি নিজেদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এসব জ্ঞানার্জনের নানা আয়োজনে সম্পৃক্ত থাকতে। আমি আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছিলাম। আমি নিজেও কক্সবাজার থেকে মিরসরাই পর্যন্ত দীর্ঘ এই এলাকায় প্রতিটি উপজেলায় এমনকি গ্রামগঞ্জেও অসংখ্য সংগঠনের আমন্ত্রণক্রমে আলোচক হিসেবে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছি। চট্টগ্রাম শহরে অনেক সিরিয়াস বিষয় নিয়ে পাঠচক্র ও আলোচনাচক্রে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। আমি শুধু তরুণদেরই সেখানে দেখতাম তা নয়; অনেক বয়স্ক মানুষও দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা শুনতেন, বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। এই ধারাটি শুধু বামপন্থি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শিক্ষা সংগঠনেই ছিল, তা নয়। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ মধ্যপন্থার দলগুলোর মধ্যেও ছিল; যাদের আয়োজনে আমি নিজেও আলোচনায় অংশ নিতে যোগদান করেছি। দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো, ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে ‘গণতন্ত্রে’ উত্তরণের পর এই চর্চাটি দুটো কারণে ভাটা পড়ে যায়। এক. সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহের পতন, সমাজতন্ত্র নিয়ে হতাশা। দুই. বাংলাদেশে দ্বিদলীয় থেকে দ্বিজোটীয় রাজনীতির উত্থান ক্রমেই বাহ্যিকভাবে আদর্শিক চর্চার চাইতে অর্থবিত্ত সমর্থক ইত্যাদি শক্তির প্রতিযোগিতার মানসিকতা বৃদ্ধি পাওয়া। এ সময় ভাবা হতে থাকে রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা আগের মতো পঠন-পাঠন, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে না হলেও চলবে। এর মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে আদর্শের চর্চার জায়গাটি উদারবাদী, রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, বামশক্তি দুর্বল হতে হতে ওইসব চর্চায় আর শক্তি জোগাতে পারছে না। এমন এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে বাম এবং গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির চর্চা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকেই নয়; সামাজিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী নানা ধরনের সংগঠন থেকেও হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা সংস্কৃতির চর্চা অনেকটাই উধাও হয়ে গেছে, লাইব্রেরি হারিয়ে গেছে। শহরাঞ্চলে কোথাও তেমন কোনো আলোচনাচক্র নিয়মিত হয় না। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক কিছু সভা অনুষ্ঠিত হয়; যেগুলোর উদ্যোক্তারা মিডিয়া কভারেজ দেওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার, আলোচনাচক্র কিংবা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কোনো আয়োজন। ছাত্র সংগঠনগুলো এখন যেসব সভার আয়োজন করে; সেগুলোর আলোচনা শোনার তেমন কোনো আগ্রহী শ্রোতা থাকে না। শিক্ষকরাও তেমন কোনো সেমিনারের আয়োজন করেন না। রাজনৈতিক দলগুলো দিবসকেন্দ্রিক কিছু আলোচনার আয়োজন করে থাকে; যেগুলোর প্রাপ্তি রাজনৈতিক মতাদর্শিক আলোচনার চাইতে প্রতিপক্ষ এবং নিজেদের কিছু বক্তব্যই মুখ্য থাকে।

এই যখন রাজনীতি, সমাজ, বিশ্ববাস্তবতা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানচর্চা, সাধারণ আলোচনা চর্চা, বইপুস্তক পড়া ইত্যাদি বিষয়ে একটা মস্তবড় অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে, তখন কি আমরা বলতে পারি যে, আমাদের সমাজে মতাদর্শের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমার যা ধারণা তা হচ্ছে মোটেও তা ভাবা উচিত হবে না। ৩০ বছর ধরে প্রগতিশীল চিন্তাধারার চর্চার অধগমন যতবেশি ঘটেছে; ততবেশি সেই স্থান উগ্র, হঠকারী, ধর্মান্ধ, রক্ষণশীল মতাদর্শের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শিক্ষাসহ নানা ধরনের গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে। যে গ্রামের কথা আগে আমি উল্লেখ করেছি; সেখানে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মৌলবাদী, ধর্মান্ধগোষ্ঠী বিনা বাধায় মগজ ধোলাইয়ের কাজটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সহায়তাদান করছেন শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ; যারা এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। আমি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমবেশি যোগাযোগ থেকেই বলতে পারি যে, একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে অগ্রসর চিন্তাধারার শিক্ষকের প্রাধান্য ছিল, সেই স্থানটি এখন পূরণ করেছেন বিপরীত মতাদর্শের ব্যক্তিরা। এ কাজ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এখন এককভাবে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীলতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি সম্পর্কে বিকৃতি ও বিভ্রান্তিকর মানসিকতা পোষণকারী শক্তির হাতে চলে গেছে। ফলে আমাদের স্কুল পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থায় যতই আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসংবলিত পাঠ্যপুস্তক পড়াচ্ছি কিংবা জাতীয় দিবস গুরুত্বের সঙ্গে পালন করছি; কিন্তু এর থেকে ইতিবাচক ফলাফল তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম কত শতাংশ তৈরি করতে পারছি, সেই পরিসংখ্যান নিলে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু হবে বলে মনে হয় না। শহরগুলোতেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নানা কারণেই পশ্চাৎপদ চিন্তাধারার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। শিক্ষকদের মধ্যেও সে রকম কোনো আগ্রহ লক্ষ করা যায় না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে প্রগতিশীলতার ধারক-বাহকের সংখ্যা ক্রমেই নি¤œগামী হচ্ছে। সেভাবে আধুনিক মতাদর্শের বইপুস্তক পড়া বা আলোচনা করার কোনো সাহসী উদ্যোগ এখন আর অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায় না। এর মানে দাঁড়াচ্ছে মতাদর্শের চর্চায় অগ্রসর মানুষ, গোষ্ঠী, দল যত স্থান ছেড়ে দিচ্ছে; তত সেই জায়গায় কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ইতিহাস বিকৃতি, লেখাপড়া না করার অপচর্চা, জ্ঞানবিজ্ঞান সম্পর্কে তেমন স্বচ্ছ ধারণা না রাখা, নানা ভুল বিশ্বাস ও কথাবার্তার মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে ফেলার সুযোগ ঘটছে। এর ফলে সমাজে আলোকিত মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অন্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ বেড়েই চলছে। তার মানে হচ্ছে, মতাদর্শের জায়গায় শূন্যতা থাকে না। পানি যেমন আধারে গড়িয়ে পড়ে, মতাদর্শও তাই রাষ্ট্র ও সমাজে জায়গা দখল করে নেয়। সেখানে প্রগতিশীলতার চর্চা না হলে প্রতিক্রিয়াশীলতার একচেটিয়া দখল প্রতিষ্ঠা অবারিত হতে বাধ্য। আমাদের দেশ শুধু নয়, প্রতিবেশী অনেক দেশেই এই সংকট অবিশ্বাস্য রকমভাবে বেড়ে উঠছে। এমনকি উন্নত গণতান্ত্রিক দুনিয়াতেও এখন বর্ণবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি মতাদর্শের পুনরুত্থান ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সেসব উন্নত দেশের অবস্থান আমাদের চাইতে অনেক ওপরে। কিন্তু আমাদের এখানে দীর্ঘদিনের লালিত অন্ধবিশ্বাস থেকে স্বল্পসংখ্যক মানুষই এ পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পেরেছেন। সেই অবস্থায় রাজনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শের অগ্রসর শক্তিসমূহ যদি তাদের দায়িত্ব পালন এভাবে ছেড়ে দেয়; তাহলে অচিরেই সব কিছু উগ্র হঠকারী মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে। আমাদের সমাজের অগ্রসর মানুষদের এ নিয়ে সক্রিয় চিন্তাভাবনা এবং দেশ, সভ্যতা, পৃথিবী ইত্যাদি নিয়ে আধুনিক মতাদর্শের চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close