রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বৈশ্বিক নিরাপত্তা হুমকিতে জলবায়ু পরিবর্তন

বিশ্বের দরিদ্র মানুষের অর্ধেকেরই বাস দক্ষিণ এশিয়ায়। সেখানে কৃষি মূলত বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভরশীল। সংশ্লিষ্ট সমীক্ষাটি তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের ঝুঁকি দূর করতে এই সমীক্ষায় দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থার প্রসার ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, খেত থেকে বাজার পর্যন্ত ফসল পৌঁছানোর উপযোগী রাস্তা তৈরি এবং কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে। হিমালয়ের গলতে থাকা হিমবাহ, খরা, অনিয়মিত বৃষ্টি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার ১.৬ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তার ওপর হুমকি সৃষ্টি করছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক সমীক্ষার রিপোর্টে এই হুমকির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ম্যানিলাভিত্তিক এই ব্যাংকের অর্থে চালিত সমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্টে এই মর্মে হুশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও আফগানিস্তানে শস্যের ফলন কমে যাওয়ার হুমকি রয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক কুনিও সেঙ্গা বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার হুমকি কৃষি তথা খাদ্য নিরাপত্তার ওপর খুবই গুরুতর প্রভাব ফেলবে। এই সমীক্ষায় আরো সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই প্রবণতা যদি বহাল থাকে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় সেচ পদ্ধতিতে পাওয়া শস্যের ফলন বেশ কমে যাবে। বলা হয়েছে, ভুট্টার ফলন কমবে ১৭ শতাংশ, গমের ফলন কমবে ১২ শতাংশ আর ধান ১০ শতাংশ। এর ফলে দেখা দেবে খাদ্যাভাব; যা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী আগামী দু-এক দশকের মধ্যেই নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। সে রকমটাই মনে করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকরা? নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গত রোববার এ কথা বলা হয়েছে? ওই প্রতিবেদনে এ বিষয়ে মার্কিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির একটি সমীক্ষা থেকে বিভিন্ন তথ্যও উদ্ধৃত করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এ রিপোর্টে যেটা বলা হচ্ছে, তা হলো বিশ্বের জলবায়ু যেভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা সামনের দশকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে এবং প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক হস্তক্ষেপও করতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি, যেটি মূলত মার্কিন সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তারা বেশ কিছু যুদ্ধের মহড়া এবং গোয়েন্দা সমীক্ষা চালিয়েছে। এ থেকে ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি এ রকম একটা উপসংহারে পৌঁছেছে যে, আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বড় ধরনের সংকট দেখা দেবে সাব সাহারান আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এসব অঞ্চলে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেবে, বন্যা, খরা আর মহামারির কারণে লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে অন্য অঞ্চলে পাড়ি জমাবে? একইভাবে আর্কটিক অঞ্চলের বরফ যেভাবে গলছে, সেখানে নতুন সমুদ্রপথ উন্মুক্ত হচ্ছে জাহাজ চলাচলের জন্য, এটির নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে চলে আসবে। সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এবং এ থেকে ভবিষ্যতে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। সুতরাং এসব কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ।

নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর পরিচালিত ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির একটি অনুশীলন এবং সমীক্ষায় বিভিন্ন রকম পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কিন সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, এ রকম পরিস্থিতিতে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। সেখানে ধর্মীয় সংঘাত শুরু হয়ে যেতে পারে, সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার ঘটতে পারে এবং অবকাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে। পেন্টাগনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমান্ডা জে ডোরিকে উদ্ধৃত করা হয়েছে এ রিপোর্টে। তিনি বলছেন, পরিস্থিতি খুব দ্রুতই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে এবং এ ধরনের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বার্থে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৬০ লাখ জলবায়ুজনিত অভিবাসী রয়েছে, যে সংখ্যাটি ২০৫০ সালের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, তখন শিশুরা কার্যকরভাবে তাদের শৈশব হারায়। শহরে তারা বিপদ ও বঞ্চনার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি শোষণ ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাইরে কাজে যেতে চাপের মুখে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয় বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। ইউনিসেফের নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশিরা দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশংসনীয় ক্ষমতা অর্জন করলেও দেশটির নবীনতম নাগরিকদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদ এড়াতে জরুরি ভিত্তিতে আরো সম্পদ ও উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি প্রয়োজন। বাংলাদেশের দরিদ্রতম কমিউনিটিগুলো পরিবেশগত যে হুমকির মোকাবিলা করছে, তা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন; যার কারণে তারা তাদের সন্তানদের যথাযথভাবে রাখতে, খাওয়াতে এবং স্বাস্থ্যবান ও শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। বাংলাদেশে এবং বিশ্বজুড়ে শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা এবং তাদের উন্নয়নে দেশগুলোর অনেক অর্জন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মøান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঝড়ের আভাস : বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ মেঘাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সমতল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ঘনবসতি ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে দেশটি শক্তিশালী ও অননুমেয় শক্তিগুলোর কাছে বিশেষভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়ছে।

এই পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে জলবায়ু পরিবর্তন। দেশটির উত্তরের বন্যা ও খরাপ্রবণ নি¤œাঞ্চল থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী ঝড় ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অঞ্চল পর্যন্ত এই হুমকি অনুভূত হয়। এ ছাড়া বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো বিরূপ আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মিলন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নোনাপানির অনুপ্রবেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি ঘটনাসমূহ পরিবারগুলোকে আরো বেশি দারিদ্র্য ও স্থানচ্যুতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর বসবাস শক্তিশালী নদীপ্রবাহের মধ্যে ও এগুলোকে ঘিরে। নদীগুলো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং নিয়মিতভাবে এগুলোর তীর ভাঙে। ব্রহ্মপুত্র নদে সাম্প্রতিক বন্যায় ২০১৭ সালে ৪৮০টি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক প্লাবিত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০ হাজার নলকূপ, যেগুলো কমিউনিটিগুলোর নিরাপদ পানির চাহিদা পূরণের জন্য অপরিহার্য ছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রতল ৯ থেকে ৪৮ সেন্টিমিটার এবং কার্বন নির্গমনের উচ্চহারে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা হচ্ছে তার ফলে সমুদ্রতল ১৬ থেকে ৬৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়বে, খাদ্যাভাব দেখা দিবে, স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়বে এমনকি ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ভূমির এক-তৃতীয়াংশ পানিতে নিমজ্জিত হবে। কী ভয়ংকর সংবাদ! এর ফলে সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলগুলোর মানুষ বাস্তুভিটা হারাবে। নদ-নদীতে লোনাপানির পরিমাণ বেড়ে যাবে, বাড়বে শরণার্থীর সংখ্যা। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়বে এবং দেশে বিশুদ্ধ পানির সংকট বেড়ে যাবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হেপাটাইটিস বি, সংক্রামক ব্যাধি, মেনিনজাইটির মতো গ্রীষ্মকালীন রোগগুলো বৃদ্ধি পাবে। সেসঙ্গে সূর্যের বিকিরণকৃত আলটাভায়োলেট রশ্মিও অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কারণে চামড়ার ক্যানসার ও চোখের ছানি পড়া রোগ বৃদ্ধি পাবে। এমনকি খাদ্যশস্যে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে যাবে। খাদ্যাভাব দেখা দেবে। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিপর্যয়কে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকর হুমকি বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এমন শঙ্কার খবরগুলো ভাবায় বৈকি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close