রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

ব্রেক্সিট ঝড়ের কবলে ব্রিটিশ রাজনীতি

একসময় রাজনীতিমনস্ক মানুষ ব্রিটেনের পার্লামেন্টকে ভালোভাবেই ফলো করত, শিক্ষণীয় অনেক কিছু তাদের কাছ থেকে আহরণ করত। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছিল, দেশে দেশে গণতন্ত্রহীনতার সময়ে ব্রিটেনের পার্লামেন্টের দেখে তারা স্বস্তি পেত। কিন্তু এই ব্রিটেনের পার্লামেন্টেই এখন মানুষের হাসির খোরাক হচ্ছে এবং ব্রিটেন দ্বিধাগ্রস্ত দেশের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। অস্থিরমতি শিশু যেভাবে কারণে-অকারণে লাফিয়ে বেড়ায়, একদন্ড স্থিরভাবে বসে না; ঠিক তেমনি ব্রিটেনের সংসদের এমপিরা এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তি পাচ্ছেন না। এ মুহূর্তে যদি সংসদে দুই দন্ড বসার সুযোগ পায়, পর মুহূর্তে দৌড় লাগাচ্ছে লবিতে ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর জন্য। প্রতি ঘণ্টায় পর্দা নামছে, নতুন পর্দা উঠছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। ব্রেক্সিট চরকির মতো ঘুরছে, ঘুরছেই! ব্রেক্সিট কার্যকর প্রশ্নে একের পর এক পরাজয়ের মধ্যে হাইকোর্টের এ রায় প্রধানমন্ত্রীর জন্য আরেকটি বড় আঘাত বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ রায়ের ফলে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী পুনরায় পার্লামেন্ট অধিবেশনের ডাক দিতে পারেন। ইতোমধ্যে আগামী ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত পার্লামেন্ট মুলতবি করা হয়েছে। অধিবেশন শুরু হলে নিয়ম অনুযায়ী রানি ভাষণ দেবেন এবং এ ভাষণের ওপর আলোচনা শুরু হবে। ফলে ব্রেক্সিট বাধাগ্রস্ত করতে বিরোধী এমপিরা তেমন বেশি সময় পাবেন না। এজন্যই মূলত বিরোধী দলগুলো সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তবে এ রায়ের ফলে সরকারের অবস্থান আরো সঙ্গিন হয়ে পড়ল।

অপরদিকে বরিস জনসনের পার্লামেন্ট মুলতবির সিদ্ধান্তকে বে-আইনি বলে ঘোষণা করেছে স্কটল্যান্ডের হাইকোর্ট। সর্বদলীয় রাজনীতিবিদদের দায়ের করা এ পিটিশনের ওপর শুনানি শেষে তিন সদস্যের বিচারক দল এ রায় দেন। আদালত বলেছেন, ব্রেক্সিট বিষয়ে পার্লামেন্টের কাছে সরকারের জবাবদিহি বাধাগ্রস্ত করতে প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী রানিকে ভুল বুঝিয়েছেন। সরকার এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবে বলে জানিয়েছে। এ রায় গত সপ্তাহে সরকারের পক্ষে যাওয়া রায়কে খারিজ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহে সেশন কোর্ট পার্লামেন্ট মুলতবি সরকারের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে রায় দিয়েছিল। শ্যাডো ব্রেক্সিট সেক্রেটারি স্যার কেয়ার স্টারমার বলেছেন, জনগণ বরিস জনসনকে বিশ্বাস করে না। এখন কোর্ট যেহেতু তার সিদ্ধান্তকে বে-আইনি ঘোষণা করেছেন, এটি অত্যন্ত শক্তিশালী। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল বর্তমানে স্বতন্ত্র এমপি ডমিনিক গ্রিভ মনে করেন রানিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দ্রুত পদত্যাগ করা উচিত। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্টিট থেকে বলা হয়েছে, এ রায় অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হবে। পার্লামেন্ট মুলতবি করা আইনসম্মত। আগামী সোমবার সুপ্রিম কোর্টে এ রায়ের বিরুদ্ধে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। ৭০ জন এমপি এবং লর্ড সভার সদস্য স্কটল্যান্ড হাইকোর্টে এ পিটিশন করেছিলেন। তাদের মুখপাত্র স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির এমপি জোয়ানা চেরি আশা করছেন সরকার দ্রুতই পার্লামেন্ট অধিবেশন আহ্বান করবে।

অন্যদিকে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিওন এই রায়কে সাংবিধানিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আচরণ ভয়ানক, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং সাংবিধানিক নিয়মকানুনের চরম লঙ্ঘন। ব্রিটেনের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আপাতত চুপ আছে, তারাও যে ভীতির মধ্যে নেই, এটা বলা যাবে না। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহৎ পার্টনার ছিল, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করলে ইউনিয়ন অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে যাবে। ইসি কোনোভাবেই এটা চাচ্ছে না, শেষ পর্যন্ত যদি ব্রিটেন চলে যায়, তবু একটা ভালো সম্পর্ক যেন বজায় থাকে; ইসি সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। অন্যান্য ২৭টি দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে যতটুকু সম্ভব সুযোগ-সুবিধা ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিতে চাচ্ছে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ভালোগুলো নিতে চাচ্ছে, মন্দের সহযোগী হতে চাচ্ছে না। শুধু ভালো সুযোগ-সুবিধা নেবে মন্দের দায়ভার নেবে নাÑ এ রকম কোনো চুক্তিতে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য অসম্ভব। তাই সমঝোতা চুক্তি হচ্ছে না। থেরেসা মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল, এতে বিরোধী দল খুশি না, তারা ইসির সঙ্গে আরো গভীর সম্পর্কে বিশ্বাসী। থেরেসা মের দলের অনেকেই বরিস জনসনসহ ইসির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে রাজি না। তাই ওই চোখ দিয়ে আলোর মুখ দেখেনি এবং থেরেসা মেকে সরে যেতে হয়েছে। ব্রিটেন ব্রেক্সিট নিয়ে গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছে, না গিলতে পারছে, না পারছে উগলাতে। তিন বছর চলে গেছে তবু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। প্রতিদিন নতুন নতুন ঘটনার জন্ম হচ্ছে।

এ পর্যন্ত দুজন প্রধানমন্ত্রী খেয়ে ফেলেছে ব্রেক্সিট। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই প্রধানমন্ত্রীও অচিরেই ব্রেক্সিটের বলি হয়ে যাবেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ব্রেক্সিট হয়ে যাবে, তবে বরিস জনসনের ব্রেক্সিট হবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ব্রিটেন একসঙ্গে না থাকলেও সহযোগী হিসেবে থেকে যাবে, ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। কোনো চুক্তি না হলে ৩১ অক্টোবর ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে, যদিও এ সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ মনে হচ্ছে। চুক্তি ছাড়া চলে আসা ব্রিটেনের জন্য ক্ষতির হবে, দীর্ঘদিনের একটা সংসারে হঠাৎ বিচ্ছেদের ঝড় উঠলে যেভাবে কোনো কিছু স্থির থাকে না, ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও তাই হবে। পুনরায় সুস্থির হতে অনেক দিন লেগে যাবে। বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মধ্যে ব্রিটেনকে আগে আর পড়তে হয়নি, তাই বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে এগোবে, কী করতে হবে। এই লেজেগোবরে অবস্থা সত্বর অন্ত হোক, মানুষ আশ্বস্ত হোক, অনিশ্চয়তার যে কালোমেঘ ব্রিটেনের আকাশ ছেয়ে আছে, তা দূরীভূত হোক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ পর্যন্ত ব্রিটেনের দুজন প্রধানমন্ত্রী বধ করেছে, আরো দু-তিনজন বধ না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না বলেই মনে হচ্ছে। ব্রিটেন গণতন্ত্রের দেশ, অতিরিক্ত গণতন্ত্র কেমন হতে পারে, এরও উদাহরণ বর্তমান ব্রিটেন। ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে চেপে ধরেছে, ব্রিটেন কীভাবে চাপমুক্ত হয়; এটা একটা দেখার দৃশ্য হবে বৈকি। আপাতত ব্রিটেনের পার্লামেন্টে উচ্চচাপযুক্ত নাটক অভিনীত হতে থাকুক! গণভোট যখন হয় ২০১৬ সালে, তখনই বেঝা গিয়েছিল এ ইস্যু বিতর্কিত হবে। কিন্তু বিতর্ক কোন পর্যায়ে যাবে, এ নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না।

ব্রিটেন বিভিন্ন বর্ণ-ধর্ম এবং জাতির দেশ। হুট করে এটাকে বদলানো যাবে না, বদলানো উচিতও না, আখেরে এর ফল ভালো হবে না। শত বছরের উদারনৈতিক ঐতিহ্য রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব না, এমন প্রচেষ্টা যারা করবে, তারাই বাতিল হিসেবে গণ্য হবে, ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। বরিস জনসনের পাঞ্জায় যতগুলো কার্ড ছিল একে একে খেলে যাচ্ছে, তবু কোনো এক্কাই কাজে লাগছে না। মরি কিম্বা বাঁচি ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করব, এমন ঘোষণা যে বুমেরাং হবেÑ এমন আলামত দেখা যাচ্ছে। বরিস জনসনকে নিজের ফেলে দেওয়া কথা নিজেকেই হজম করতে হবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন নিয়ে হাজির হতে হবে। তরী পার যত সহজ হবে ভেবেছিল বৈঠা ঠেলতে গিয়ে; এখন তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। সাঁতার না জানা লোক ভালোভাবে বৈঠা খেলতে পারছে না, বিদ্বেষ বা খুব মনে রাখলে পার হওয়া যায় না বরিস জনসনের উদাহরণ হতে পারে রাজনীতির গুটি খেলায় বরিস জনসন নির্বাচন চাচ্ছে, মনে করছে পপুলিস্ট এজেন্ডায় সে জিতে যাবে। বিরোধী দলও কম সেয়ানা নয়, তারা তাকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়বে। সহজে ওয়াক ওভার বরিস জনসন পাবে না। নির্বাচন হয়তো হবে, কিন্তু তার আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যেকোনো রকমের সমঝোতায় আসতে হবে। টালমাটাল ব্রিটিশ রাজনীতিতে মিনিটে মিনিটে নাটকীয়তা। কে ধারণা করেছিল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিন দফা পরাজয় ঘটবে একজন প্রধানমন্ত্রীর। নিজ দলে বিদ্রোহ নতুন কোনো খবর নয়। কিন্তু আপন ভাই যখন দল ও মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে যান; তখন বিষয়টি আমলে না নিয়ে কোনো উপায় নেই। ৪৪ দিন বয়সি প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একের পর এক সংকটের মুখোমুখি।

ব্রেক্সিট ইস্যু ব্রিটিশ রাজনীতিতে পালাবদল ঘটিয়ে চলেছে। দুজন প্রধানমন্ত্রী বিদায় নিয়েছেন, নয়া নির্বাচনের দিকেও ঠেলছে পরিস্থিতি। ১৮ অক্টোবর ভোট করতে চেয়েছিলেন বরিস জনসন। এমপিরা এতে সায় দেননি। বিশেষ করে বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন বেঁকে বসেন। জনসন বলেছেন, এটা কাপুরুষতা। সারা বছর যেখানে আগাম নির্বাচনের কথা বলে সেখানে নির্বাচনের ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে কী আনন্দ রয়েছে। তার মতে, এটা হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রতি অবমাননা। করবিন এর জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, কে বলেছে আমরা নির্বাচন চাই না। আমরা অবশ্যই নির্বাচন চাই। চুক্তিহীন ব্রেক্সিট ইস্যুটির ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নয়। করবিন শুরুতে নির্বাচনের ব্যাপারে দোটানায় ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার করবিনকে স্মরণ করিয়ে দেন এ সময়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলে মস্তবড় ভুল হবে। ১৫ অক্টোবর নির্বাচনের মধ্যে বরিস জনসনের ভিন্ন কৌশল রয়েছে। এই যখন অবস্থা, তখনই খবর এলো বরিস জনসনের ভাই জো জনসনের পদত্যাগ। মন্ত্রী এবং দল থেকে তিনি পদত্যাগ করেছেন। ৯ বছর ধরে তিনি ৩ জন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে মন্ত্রী ছিলেন। এক টুইট বার্তায় বলেছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে পারিবারিক বিশ্বস্ততা ও জাতীয় স্বার্থ নিয়ে আমি চাপের মধ্যে ছিলাম। এটা আমার জন্য অসমাধানযোগ্য একটি উদ্বেগ। মধ্যবর্তী নির্বাচনের যে প্রস্তাব ছিল, তা পরাজিত হয়েছে বিরাট ভোটের ব্যবধানে। তাই ব্রিটেনের অন্যতম বিরোধী নেতা লিবারেল ডেমোক্রেটের উপনেতা এড ডেভি বলেছেন, জনসনকে বিশ্বাস করা যায় না। চুক্তিহীন ব্রেক্সিট যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close