রহিমা আক্তার মৌ

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

নিয়মনীতি ও আমাদের উদাসীনতা

দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি লাইব্রেরিগুলো লেখক ও প্রকাশকদের কাছ থেকে প্রায় প্রতি বছর বই ক্রয় করে। এটা আগে থেকেই জানা আমার। কীভাবে কী করতে হয়, আমি জানি না। পত্রিকায় সার্কুলার দেখে লেখক হিসেবে বই জমা দেব। চৌধুরী সাব্বির ভাইয়ের সহযোগিতায় কাগজপত্র রেডি করে জমা দিই। গত বছর পাবলিক লাইব্রেরি আমার মুক্তিযুদ্ধের বই ‘একাত্তর ও নারী’ বইটি ক্রয় করে। ইসলামী ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররম মুক্তিযুদ্ধের বই ‘একাত্তর ও নারী’ ও প্রবন্ধের বই ‘নক্ষত্ররাজির কথা’ ১৩১ (একশ একত্রিশ) কপি করে ক্রয় করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বই ক্রয় করার জন্য সার্কুলার দেয়। গত বছরের মতো সাব্বির ভাইয়ের সহযোগিতায় সিডি আর ফরম রেডি করি। এসব দেখেই অভ্র বলে, ‘নিজে কাজ শিখো, ল্যাপটপ কেন’। কিন্তু কে কিনে দেবে, কে শিখাবে? বই জমা দিতে যাব শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরিতে। লেখালেখি করলেও আমার প্রথম কাজ পরিবারের তিন ‘স’ (স্বামী, সন্তান, সংসার) এর দায়িত্ব পালন করা। সাধারণত ভোর থেকে সকাল ৯-১০টা পর্যন্ত সংসারের কাজ করে পড়ালেখা করতে বসি ১২টা পর্যন্ত। এই দুই ঘণ্টা ছুটা বুয়া কাজ করে। ১২টায় উঠে একটু কাজ সেরে নামাজ পড়ে ১টায় অভ্রর স্কুলে।

পাবলিক লাইব্রেরি যাব অপেক্ষা করছি বুয়ার জন্য। ১০টায় আসার কথা থাকলেও ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বের হয়ে যাই। ইচ্ছা ছিল তাকে ঘরে রেখে এই ফাঁকে কাজ সেরে আসব। কিন্তু নিয়মের ব্যাঘাত শুরু এখান থেকেই। ফার্মগেট থেকে শাহবাগ বাসে যেতে খুব বেশি হলে ১৫ মিনিট লাগার কথা। সেখানে ৪০ মিনিট সময়ে পৌঁছালাম কারওয়ানবাজার। ড্রাইভারের বাম পাশে দুই সিট, সামনের সিটে ৩৫-৩৮ বছর বয়সি এক নারী, পেছনের সিটে ৫০ বছর বয়সি এক নারী, আমি পেছনের সিটে বসি। একটু পর ৫০-৫৫ বয়সি এক লোক এসে বসে সামনের সিটের মহিলার পাশে।

কারওয়ানবাজার থেকে ১০ মিনিটে পরিবাগ পৌঁছাই। পরিবাগ যাওয়ার পর ড্রাইভার-হেলফার বলল, ‘বাস সোজা যাবে না, বামদিক দিয়ে যাবে। যারা শাহবাগ নামার কথা তারা এখানে নেমে যান।’ কথাটা শুনে পুরাই মাথা খারাপ। এখান থেকে হেঁটে পাবলিক লাইব্রেরি যাওয়া আমার সম্ভব নয়। কারণ আমার পায়ে সমস্যা। ৫-৬ জন যাত্রী শাহবাগ নামার কথা। আমিসহ দুই মহিলা। বাস সোজা কেন যাবে না জিজ্ঞেস করায় তারা জানায়, সোজা গেলে অনেক সময় লাগবে, সামনে জ্যাম। পেছন থেকে কয়েকজন পুরুষ যাত্রীর কথা, ‘আপনাদের কয়েকজনের জন্য কি সবাই জ্যামে থাকবে? ওই তো শাহবাগ দেখা যায়, একটু হেঁটেই যান। দুই মিনিট সময় লাগবে।’ এই নিয়ে কথা কাটাকাটি, কিছুই হলো না। বাধ্য হয়ে সেখানেই নামতে হয় আমায়। ১০ মিনিটে হেঁটে শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরি গেলাম। মানে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ আসতে এক ঘণ্টা শেষ।

কাজ সেরে ৩০ মিনিটের মাথায় আবার শাহবাগ এসে মিরপুরের একটা দোতলা বাসে উঠি। বাসটি তখন ফুলের দোকানগুলোর সামনে সিগন্যালে ছিল। ঢাকা শহরে এমন অল্প সময়ের যাতায়াতে আমি দোতলা বাসই পছন্দ করি, কারণ এগুলো দুই দুয়ারি বাস। ওঠানামায় ধাক্কাধাক্কি হয় কম। বাসে উঠেই সামনের সারির লাগানো চারটি সিটের একটিতে বসি। দুই পাশে দুই সিট খালি। সামনের দরজা দিয়ে উঠতে ডান পাশের দুই সিট মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। মানে সেই ‘নারী শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য’ লেখা সিট। সেই দুই সিটে বসে আছে পুরুষরা। ব্যক্তিগতভাবে নিজের জন্য আমি বাসে উঠে কখনো পুরুষদের বরাদ্দ মহিলা আসন থেকে সরতে বলি না। তবে অন্যদের জন্য বলি। বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের সামনে বাস এলেই অনেকে ওঠে। হেলপার বারবার পুরুষদের বলছে পেছনের গেট দিয়ে উঠতে। কারণ সামনের গেট দিয়ে মহিলারা উঠছে।

কয়েকজন মহিলা উঠল, দুজন দাঁড়িয়ে আছে। অথচ মহিলা সিটে বসে ঘুমাচ্ছে এক লোক। হেলপারকে বললাম সিট খালি করতে, বুঝলাম সে বললে ঘুমন্ত লোক উঠবেন না। তাই নিজেই বললাম। প্রথম বলার পর উঠেনি, পরে বললাম, ‘বাসে লেখা মহিলা ও প্রতিবন্ধী, তার মানে মহিলা ছাড়া মহিলা সিটে যারা তাদের সবাই প্রতিবন্ধী।’

কথাটা খুব লেগেছে লোকের, বাধ্য হয়ে উঠলেন, মহিলারা বসল। ২৫-৩০ বছর বয়সি এক মহিলা হাতে কলা, পাউরুটি, পানি নিয়ে উঠলেন। সিট পেয়ে বসেই কলা-পাউরুটি খাওয়া শুরু করলেন। আমি অপেক্ষা করছি ওর কলার ছাল কই রাখে, তা দেখার জন্য। হায় হায়, মহিলা কলা খেয়ে টপ করে জানালা দিয়ে ছাল বাইরে ফেলল। আমি পুরাই অবাক। মনে হচ্ছে, এই রাস্তাটা ওর বাপে রেখে যাওয়া ডাস্টবিন। অপেক্ষা করছি আরেকটা কলা খাওয়ার। দ্বিতীয় কলা প্রায় খাওয়া শেষের দিকে আসতেই বললাম, ‘কলার ছালটা বাইরে না ফেলে আপনার ব্যাগেই রাখেন।’

কথা শুনে তিনি তাই করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের দু-তিনজন মাথা নাড়ালেন। ওরা বোঝাতে চেয়েছেন যে আমি ঠিক কাজটাই করেছি। এরই মাঝে মহিলা তৃতীয় কলা খেলেন। খেয়ে কলার ছাল ব্যাগেই রাখলেন। হেলপার সামনের গেট দিয়ে মহিলা উঠাচ্ছে দেখে কথা বললাম, সে জানাল, ‘আপা চেষ্টা করি পুরুষদের পেছনের গেট দিয়ে ওঠাতে, কিন্তু কিছু লোক কথাই শুনে না। তারা সামনে দিয়েই উঠবে।’ ওকে বললাম, ‘আপনার দায়িত্ব আপনি পালন করবেন, সবাই না শুনুক, কিছু লোক তো শুনবেই। এক দিন দেখবেন, এটা নিয়ম হবেই যে পুরুষরা পেছনের গেট দিয়েই উঠতে হবে। আর আমরা ও দাবি জানাচ্ছি সব বাস দুই দুয়ারি করার জন্য।’ কথা শুনে হেলপার খুশি হলেন। ফার্মগেট বাস চলে আসে, আমি নেমে পড়ি। হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারি আমার পায়ে ফোঁসকা পড়েছে সেই পরিবাগ থেকে হেঁটে যাওয়ার জন্য। পায়ের জুতার পেছনের অংশ নামিয়ে দিয়ে অনেক কষ্টে বাসায় আসি ১২টা ৪৫ মিনিটে। যাই অভ্রর স্কুলে। বাসায় এসে শুনি বুয়া এসেছিল দুপুর ১২টায়। অথচ তার আসার কথা ছিল ১০টায়। শুনেছি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ এক ঘণ্টা আগে বা পরে খাওয়া যায়। এর বেশি নড়চড় করা যায় না। আমিও বুয়ার জন্য ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম, কিন্তু সে তখন আসেনি।

মাত্র দুই ঘণ্টার কিছু কথা এখানে, যার অধিকাংশ অংশ জুড়ে রয়েছে অনিয়ম, সচেতনহীন ব্যক্তিদের উদাসীনতা। যাওয়ার সময় জ্যামে প্রচুর সময় লাগে, আসার সময় অল্প। কিন্তু যাওয়া আর আসা দুই সময়েই দেখেছি বাসচালকদের প্রতিযোগিতা। যা সম্পূর্ণরূপে বে-আইনি। যাওয়ার সময় জ্যাম ছাড়লেই বাস চলতে গিয়ে লাগিয়ে দেয় অন্য বাসের সঙ্গে। আসার সময় রাস্তা ফ্রি, পাশাপাশি মিরপুরের দুই বাস হওয়ায় কে কার আগে যাবে। অথচ আমরা একটু সচেতন হলেই কোনো অনিয়ম থাকে না। প্রত্যেক ব্যক্তিই যদি নিজের কাজ ঠিক সময়ে করি; তাহলে সমস্যাই থাকে না। যদি ঠিক দায়িত্ব পালন করি, কেউ কাউকে কিছু বলতে পারবে না। বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরে নিজের টাইমলাইনে লিখি, “রহিমা তুই ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো দরকার নাই, তুই বাসায় থাক। কে বাসে তাকাল, কে বাস জোরে চালাল, কে মহিলা, কে প্রতিবন্ধী আর কে কলার ছাল ফেলল তা দেখতে হবে না। তুই ঘরে বসে জীবনের তিন ‘স’ (স্বামী, সন্তান, সংসার)-এর দায়িত্ব পালন কর। সাহিত্যিক সাংবাদিক কলামিস্ট হওনের দরকার নাই, সেসব হওনের অনেক লোক আছে।”

প্রিয় পাঠক, আমার এত সমস্যার কথা শুনে হয়তো বলবেন, আমি বাসে না গিয়ে সিএনজি বা উবারে যাইনি কেন? শাহবাগ যেতে আর আসতে আমার খরচ হয়েছে ১০+৫= ১৫ টাকা। আর সিএনজি বা উবারে যেতে ভাড়া লাগত ২০০-২৫০ টাকা আবার আসতে ২০০-২৫০ টাকা। যেখানে নিয়ম মেনে বাস গেলে আমি ১৫ টাকায় যাওয়া-আসা করতে পারি, সেখানে ৪০০-৫০০ টাকা খরচ করব কেন? বা কই থেকে? মহিলাদের চলার পথে পাবলিক বাসে উপযুক্ত সেবা না পেয়ে অতিরিক্ত খরচে চলতে হয় এমন ঘটনা নিয়ে বহু লিখেছি। পরিশেষে একটাই কথা, নিয়ম আর নীতি ঠিক রাখলে প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের নিরাপদ হতে পারে।

লেখক : সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close