নিতাই চন্দ্র রায়

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

নদী রক্ষায় গণ-আন্দোলন জরুরি

নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। মানুষের জীবনযাপন, সভ্যতার বিকাশ ও ঐশ্বর্য নির্মাণ, ইতিহাস, আন্দোলন-সংগ্রাম সব কিছুতেই নদী দৃঢ়তর ভূমিকা পালন করে। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে দেশের হাটবাজার, শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ ও জনপদ। দেশের কৃষি, মৎস্য, পরিবহন ও পর্যটন খাত এখনো নদীর ওপর নির্ভরশীল। গ্রামের মানুষ এখনো নদীতে গোসল করে। কাপড় কাচে। থালাবাসন মাজে। জেলেরা মাছ ধরে। মাঝি নৌকা চালায়। বাংলাদেশকে মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করলে নদীগুলো তার ধমনি, শিরা ও উপশিরা। ধমনি, শিরা ও উপশিরা ছাড়া মানুষ যেমন বাঁচে না, তেমনি নদী ছাড়াও বাংলাদেশ বাঁচতে পারে না। নদীর সঙ্গে এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতিরও রয়েছে গভীর সম্পর্ক। মাইকেল মধুসূধন দত্ত তার ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় কপোতাক্ষ নদকে তুলনা করেছেন মাতৃভূমি স্তনে প্রবাহিত দুগ্ধস্রোতের সঙ্গে। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে থেকেও তিনি তার বাল্য স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদের কথা ভুলতে পারেননি। আক্ষেপ করে বলেন, পৃথিবীর বহু দেশে বহু নদী তিনি দেখেছেন। কিন্তু ওইসব নদী তার স্নেহের তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য উপন্যাস। ধীরে বহে মেঘনা সিনেমাটি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য জুুগিয়েছে অসীম প্রেরণা। এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে। আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়...। এখানে নদীও নারীর মতো কথা কয়। এ গানটিও বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে জুগিয়েছে সীমাহীন সাহস। এ ছাড়া নদীকে কেন্দ্র করে কত ভাটিয়ালি গান রচিত হয়েছে, তার সংখ্যা বলে শেষ করা যাবে না। এসব ভাটিয়ালি গানে মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও হাসি-কান্নার কথাই ধ্বনিত হয়েছে।

দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়াতে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেন, বাংলাদেশে রয়েছে অনেক নদী। নৌপথ হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের সবচেযে ভালো রুট। আমাদের নদীগুলো থেকে লাভবান হওয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। নদীর জমি পুনরুদ্ধার হলে দেশ আরো উন্নত হবে। ভূমি পুনরুদ্ধারের সুবাধে বিনিয়োগ ও কৃষিজমি বাড়বে এবং দারিদ্র্য নির্মূল হবে। এজন্য নদী সম্পদকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। নদীর প্রতি মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের কারণে দেশের অধিকাংশ নদীই আজ মৃতপ্রায়। একসময় বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় সাড়ে ১১০০ নদী ছিল। এখন আছে মাত্র ৪০৫টি। নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। তাই নদী নিয়ে পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞসহ সাধারণ মানুষের যত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। সারা পৃথিবী জুড়েই চলছে নদী রক্ষার আন্দোলন। এ কারণে নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বব্যাপী বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব নদী দিবস’। আর বাংলাদেশ তার এক দিন আগে এ দিবসটি পালন করে আসছে। বাংলাদেশে এবারের বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছেÑ ‘নদীর জন্য পদযাত্রা’ (মার্চ ফর রিভার)। গত বছরের প্রতিপাদ্য ছিল ‘দখল-দূষণ মুক্ত প্রবাহমান নদী, বাঁচবে প্রাণ ও প্রকৃতি’। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে আসছে।

বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, হাইকোর্টের রায়ে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’, ‘আইনি সত্তা’ ও ‘আইনি ব্যক্তি’ হিসেবে ভূষিত করা হয়েছে। আমরা সরকারি সব দফতরকে সার্বিক সহযোগিতা দেওয়ার পরও গত ১০ বছরে একটি নদীও পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার ইচ্ছা করলে নদী রক্ষা করতে পারে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নদী রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সারা দেশে ৪ হাজার ৪৪৩ জন নদী দখলকারী চিহ্নিত করা হয়েছে। এ তালিকা ধরে পর্যায়ক্রমে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি। তার মতে, দেশের নদীগুলো শিল্পপতি ও ক্ষমতাসীনদের লুটপাটের কবলে। সরকারের ওপর মহল থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, তা নিচের স্তরে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শুধু প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে একদিকে নদী থেকে দখল উচ্ছেদ হচ্ছে, অন্যদিকে আবার দখল হচ্ছে। ফলে নদী রক্ষায় কোনো সুফল মিলছে না। আমাদের অভ্যন্তরীণ নদীর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নদীগুলোকেও রক্ষা করতে হবে। ফারাক্কার পর ভারত কর্তৃক গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ ও একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা নদীও শুকিয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধ অঞ্চলের লাখ লাখ কৃষক ও মৎস্যজীবীদের ওপর। প্রতি বছর গড়ে একটি নদী ১৫টি খাল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যা সারা বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কে ৭০টি সংগঠনের নেতাকর্মীরা জমায়েত হয়ে পদযাত্রা শুরু করবে। এই পদযাত্রা বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে সদরঘাট টার্মিনালে গিয়ে শেষ হবে। এতে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীসহ সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের প্রশ্ন হলোÑ শুধু রাজধানী ঢাকায় এ ধরনের একটি পদযাত্রার আয়োজন করলেই কি ‘বিশ্ব নদী দিবস’ কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল হবে? সারা দেশের মানুষের মধ্যে কি নদী সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হবে? আমার মনে হয়, সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ব নদী দিবসটি যথাযথ গুরুত্বসহকারে পালন করা উচিত। প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলা সদরে এ ধরনের পদযাত্রার আয়োজন করা উচিত। পদযাত্রা ছাড়াও নদীর উপকারিতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব, নদীদূষণ, নদী দখল প্রভৃতি বিষয়েও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতে পারে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায়। এসব আলোচনা সভায় নদী রক্ষার ব্যাপারে হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়, সরকারি নীতি ও কৌশল সম্পর্কে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখতে পারেন। জেলা ও উপজেলার স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলের নেতা ও পরিবেশবাদী সংগঠনের সদস্যরাও এ ধরনের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। ব্যক্ত করতে পারেন নদী রক্ষার অঙ্গীকার। হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায় অনুসারে নদী দখলকারীদের নাম ওই দিবসে জাতীয় ও স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া উচিত। সরকার যদি সৌন্দর্যমন্ডিত হাতিরঝিল থেকে ‘বিষফোঁড়া’খ্যাত বিজিএমই-এ ভবন ভেঙে ফেলতে পারে, তাহলে নদী তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনাগুলো দেশ ও জাতির স্বার্থে অপসারণ করতে পাররে নাÑ এটা আমার বিশ্বাস হয় না। দেশের একশ্রেণির অতিলোভী শিল্পপতিই নদ-নদীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছেন। তারা শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করেই সরাসরি নদীতে নিক্ষেপ করছেন। এতে দূষিত হচ্ছে পানি। মারা যাচ্ছে মাছসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। মানুষ ও গবাদিপশু আক্রান্ত হচ্ছে নানা রকম চর্মরোগে। এ তরল বর্জ্যরে কারণেই বিনষ্ট হচ্ছে কৃষিজমির উর্বরতা। খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করছে পারদ ও সিসার মতো ভারী ধাতব পদার্থ। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যানসারের মতো জটিল রোগে। তাই আমাদের কথাÑ যেখানে-সেখানে শিল্প-কলকারখানা স্থাপন না করে নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল বা শিল্প পার্কেই শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে এবং প্রতিটি শিল্প-কারখানাতেই বাধ্যতামূলকভাবে তরল বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই তরল বর্জ্য নদ-নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয়ে ফেলা যাবে না। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরকে আরো কঠোর ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া দেশের নদীগুলোকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। বাঁচানো যাবে না বাংলার সবুজ- শ্যামল প্রকৃতি। দেশের নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো দখল ও দূষণে ধ্বংস হয়ে গেলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামতে নামতে এমন পর্যায়ে যাবে, যখন গভীর নলকূপের সাহায্যেও ভূগর্ভ থেকে সুপেয় পানি উত্তোলন করা সম্ভব হবে না। তখন চেন্নাইয়ের মতো রেলগাড়ি দিয়ে পানি এনে জারিকেনের মাধ্যমে খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে নগরবাসীদের মধ্যে। বাংলাদেশে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হোকÑ এটা কারো কাম্য নয়। তবে সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নদী দখল ও দূষণের কারণে শুধু সুপেয় পানিরই অভাব হবে না। আমাদের কৃষি, মৎস্য চাষ, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পরিবহন, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই যেভাবেই হোক জাতীয় অস্তিত্বের স্বার্থেই আমাদের নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোকে রক্ষা করতে হবে। নদী রক্ষা আন্দোলনকে ছয় দফা আন্দোলনের মতো সারা দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। জনসভা, পোস্টারিং, লিফলেট বিতরণ, মাইকিং এবং টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে সংবাদ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করে ‘নদী রক্ষাকে’ মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি গণ-আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নদীর প্রতি ভালোবাসা ও গভীর মমত্ববোধ সৃষ্টির জন্য নদীর প্রয়োজনীয়তা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব, নদী দখল ও দূষণে অপকারিতার বিষয়গুলো স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close