আকমল হোসেন
পর্যালোচনা
৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন ও আজকের শিক্ষাব্যবস্থা
১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শিক্ষাদিবস/শিক্ষা আন্দোলন। শিক্ষার অধিকার আদায়ে ওইদিন ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেটে জীবন দিতে হয়েছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতাদের। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রদান করা হয়েছিল। শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থায় বেমানানই ছিল না, ছিল অপ্রাসঙ্গিকও। এগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা সংকোচন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছরের শেষ পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধি প্রস্তাবনা অন্যতম। এগুলো বাতিলের দাবিতে ৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। সেই ধর্মঘট পালনকালেই পুলিশি এ হত্যাকান্ড ঘটে। পরে আইয়ুব খান শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করেছিল।
শিক্ষা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে পৃথিবীর দেশে দেশে গৃহীত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় নাগরিকের জন্য শিক্ষা লাভের অধিকার ঘোষণা করা হয়েছে। অন্ততপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে সহজলভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সবার জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে। এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণের পর জাতিসংঘ সব সদস্য রাষ্ট্রকে ঘোষণাপত্রের বিষয়বস্তু প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানায়। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সবারই দায়িত্ব বর্তায় এগুলো বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে সেটা কার্যকর হয়নি। বরং ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান প্রথমেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বাংলা ভাষা ধ্বংসের চক্রান্ত করে ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে উর্র্দুর কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশি হামলায় সাতজন বামপন্থি রাজনীতিককে হত্যা ও ৩২ জনকে আহত করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে গুলি চালায়, এতে সালাম, বরকত, রফিক, সফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম জানা অনেকে শহীদ হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ৯২-এর ‘ক’ ধারা জারির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়।
স্বাধীন পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত একটি সংবিধান পর্যন্ত প্রণয়ন সম্ভব হয়নি। বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থবিরোধী নানা কালাকানুন জারি করতে থাকে পাকিস্তানের শাসকরা, শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিকশিত মানবতার পরিবর্তে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন এবং রাজনৈতিক মহলে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও পাকিস্তানে ব্রিটিশদের মতোই পুঁজিবাদী তথা ধনিক বণিকনির্ভর লুটেরা অর্থনীতির পথ অনুসরণ করে। ১৯৫৬ সালের গৃহীত সংবিধানে সম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রগতিশীলতা অবরুদ্ধ হয়, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে ধ্বংসের চক্রান্ত হয়। এসব কারণে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সামরিক শাসন বলবৎ থাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং বন্ধ হয়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সীমিত পরিসরে প্রভাতফেরি হতো। ১৯৬২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রনেতাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
শিক্ষা কী? কেন এবং কীভাবে এটা প্রদান করা যায়; সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভোগবাদী সমাজে মুনাফাভিত্তিক এবং পুঁজিবাদী সমাজে যেভাবে সব কিছুকে পণ্য হিসেবে ভাবা হচ্ছে, শিক্ষাকেও এমন ভাবার চেষ্টা করা হলে ভুল করা হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা এখনো অধিকাংশ দেশে সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সেই বিবেচনায় শিক্ষার দর্শন নির্ধারিত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার কথা নয়। এ জন্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের বিষয়েও ভাবনার উন্নতি হওয়া দরকার। ব্যক্তির দেহ ও মনের সব ক্ষমতা বিকশিত, বিবর্তিত মার্জিত করে, তাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলার ব্যবস্থাদির নাম যদি শিক্ষা হয়, তাহলে মানবতাবাদী এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা এমন হবে; যেখানে সবার জন্য একই ধরনের অসাম্প্রদায়িকও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা হওয়া দরকার। পৃথিবীর যেসব দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি আর অর্থনীতিতে এগিয়েছে; তাদের শিক্ষার ইতিহাস এমনটাই। শিক্ষার দর্শন হিসেবে বিজ্ঞানই অন্যতম মাধ্যম। এই ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যুগের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে কি? ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে লর্ড মেকলেকে দিয়ে সেই শিক্ষানীতি দেওয়া হয়েছিল, যা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ও হিসাব-নিকাশ করার মতো একটি জাতি সৃষ্টি ছাড়া সৃজনশীল ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী বা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো চেতনাবোধ ওই শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়নি। ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সংবিধান (১৯৫৯) গৃহীত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে এবং সংবিধানের ১৭-এর খ ধারার আলোকে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় বাজেটে জিডিপির প্রাথমিকভাবে ৫ শতাংশ এবং পর্যায়ক্রমে ইউনেসকোকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু একবারে ৩৫১৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারীকরণ করেছিলেন, তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলে আরো ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ করা হয়েছে, যদিও এখনো ৪ হাজারের মতো বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস, সেই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকেও আবার সাম্প্রাদায়িক করা হয়েছিল, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে। সংবিধানে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের (তিনধারার) শিক্ষা বহাল রয়েছে। শিক্ষায় অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, ফলে শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে গোল্ডেনের সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। বেসরকারিভাবে গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকরা শিক্ষা ব্যবসা শুরু করে শিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মতো বেচা-কেনা হচ্ছে। এটি একটি স্বাধীন দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক, তবে এটাই এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে। ২০১০ সালে বর্তমান
সরকার একটি শিক্ষানীতি দিয়েছিল, যেখানে শিক্ষার দর্শনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিধান যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি। বরং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় শিক্ষা কারিকুলামে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়েছে। একাডেমিক ও কারিকুলামগত স্বীকৃতি না থাকলেও কওমি মাদরাসার শেষ পর্যায়ের শিক্ষাকে মাস্টার্সের মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে হযবরল সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই শিক্ষাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
লেখক : অধ্যক্ষ, সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
"