ইসমাইল মাহমুদ

  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

মাদক রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

বাংলাদেশে এক জটিল ও কঠিন সমস্যার নাম মাদক। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। কোনো পরিবারের কেউ মাদকাসক্ত হলে; সে পরিবার পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরিবারটিতে নেমে আসে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ। একজন মাদকাসক্ত একটি পরিবার, একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সমস্যায় পরিগণিত হয়। মাদকের করালগ্রাস থেকে যুব ও তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সব সচেতন নাগরিকের ঐকান্তিক প্রয়াস।

এক : মাদকদ্রব্য আমাদের সমাজে চরম বিরূপ প্রভাব যে ফেলে, তার প্রমাণ রয়েছে অসংখ্য। দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে প্রায় প্রতিনিয়তই মাদকের কারণে পরিবার ও সমাজের ওপর দিয়ে বয়ে যায় দুর্ভোগের কালো ছায়া। মাদকাসক্ত ব্যক্তির হাতে মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজন খুনের ঘটনা ঘটেছে অসংখ্যবার। মাদকের কারণে এ দেশে বহু পরিবার ধ্বংস হচ্ছে। আমরা যদি কয়েক বছর আগের দিকে তাকাই; তবে এ ধরনের ভূরি ভূরি ঘটনার প্রমাণ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মাদকাসক্ত ঐশী রহমানের কথা দেশের কোনো মানুষের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগের নিজ বাসা থেকে পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মাহফুজুর রহমান-স্বপ্না রহমান দম্পত্তির কন্যা মাদকাসক্ত ও বিকারগ্রস্ত মাত্র ১৯ বছর বয়সি কন্যা ঐশী রহমান নিজে তার বাবা-মাকে হত্যা করে। ঐশীর পরিবার-পরিজনদের মধ্যে কারো ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। ১৭ আগস্ট ঐশী নিজে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করে। এরপর ২৪ আগস্ট আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন তিনি। ঐশী রহমান শিশা, গ্যালোজ, ইয়াবা, হুইস্কি ও গাঁজা সেবন করত বলে জানা গেছে। মাদকের ফলে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে ঐশী। যার পরিণতিতে নিজ কন্যা ঐশীর হাতে বাবা ও মা হত্যাকান্ডের শিকার হন।

দুই : বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি নানা ধরনের মাদক সেবন করে থাকে। এদের মধ্যে শতকরা ৮৭ ভাগ পুরুষ ও ১৩ ভাগ নারী মাদক গ্রহণ করে। অর্থাৎ মোট মাদকসেবীর মধ্যে ৫৬ লাখ ৫৫ হাজার পুরুষ এবং ৮ লাখ ৪৫ হাজার নারী মাদক সেবন করে থাকে। এরমধ্যে শিশু এবং পথশিশুরাও রয়েছে। আর মাদক ব্যবসার সঙ্গে নানাভাবে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ। অবৈধভাবে মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি দেশি মুদ্রা পাচার হয়। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপে এসব তথ্য ওঠে এসেছিল। কিন্তু বর্তমানে সরকারের মাদকবিরোধী নানা পদক্ষেপের কারণে এ পরিসংখ্যান থেকে অনেক উত্তরণ ঘটেছে। আগের মতো হাতের নাগালে পাওয়া যায় না মরণনেশা মাদকদ্রব্য। ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতি বছর শুধু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এ দেশে প্রবেশ করে। সরকারের কঠোর ও জোরদার পদক্ষেপের কারণে নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য আমদানি, বিক্রি ও সেবন আগের তুলনায় অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। তবে মাদক আমদানি, বিক্রি ও সেবন পুরোপুরি রোধ করা যায়নি।

তিন : আমাদের দেশে মাদক একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। এরচেয়ে বড় কথা মাদক আমাদের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে চলেছে। মাদকবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি দেশি মুদ্রা পাচার হয়। ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশে আনুমানিক ৩২ রকম মাদকের খোঁজ পাওয়া যায়।

চার : বাংলাদেশে মাদকাসক্তির প্রধান শিকার যুব ও তরুণ সমাজ। যুব ও তরুণ সমাজ জাতির প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত। তরুণ ও যুবকরাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের চালিকাক্তি। তরুণ ও যুবসমাজকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হলে প্রথমেই পরিবার থেকে নিতে হবে উদ্যোগ। বিশেষ করে ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সি সন্তানরা কখন ও কোথায় যাচ্ছে, কার কার সঙ্গে মেলামেশা করছে; সেসব বিষয়ে অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে। এ ছাড়া মাদকাসক্তির যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হতাশা। হতাশা রোধে যুব ও তরুণ সমাজের জন্য নিয়মিত লেখাপড়া, খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা, বই পড়ার দিকে উদ্ভূত করতে হবে। সর্বোপরি যুব ও তরুণ সমাজের মনে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করতে পারলে মাদকের করালগ্রাস থেকে যুব ও তরুণ সমাজ রক্ষা পাবে। মাদকের কারণে এ দেশে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। মাদকের ভয়ংকর আগ্রাসন থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি মাদকবিরোধী গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। সরকার বা কোনো একক সংস্থার পক্ষে মাদকবিরোধী সংগ্রামে শতভাগ জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষকে মাদকবিরোধী আন্দোলনে শরিক হতে হবে। কোনো এলাকায় মাদকের আখড়া বলে বিবেচিত হলে তা ধ্বংসকরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। তবেই সম্ভব একটি মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া।

পাঁচ : মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করে তার মধ্যে একটি পুরোনো সংস্থা সাংহাইতে স্থাপন করা হয় ১৯০৯ সালে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এই সংস্থার কাজকে অনুমোদন করে মডেল হিসেবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ থেকে বলা হয়, মাদক একটি জনস্বাস্থ্যবিরোধী প্রক্রিয়া। এটি নিরাপত্তা ও মঙ্গলকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ না করলে এটি একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই মাদকের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। একজন মাদকাসক্ত অপরাধী নয়, অসুস্থ। তার সুচিকিৎসা করলে সে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে আবার সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চরম ঘৃণার চোখে দেখা হয়। এতে সমাজের ভালো থেকে মন্দই বেশি হয়। কেউ জন্ম থেকে মাদকাসক্ত হয় না। যেসব কারণে একজন মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে উঠে, তার কারণ চিহ্নিত করে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মাদকের করালগ্রাস থেকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ ছাড়া সমাজ থেকে মাদক উচ্ছেদে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়; দেশের সব সচেতন নাগরিককে ভূমিকা নিতে হবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close