ফিরে আসুক ঢাবির হারানো ঐতিহ্য
যে মুহূর্তে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে সম্পর্ক এবং উন্নয়ন অংশীদারত্বে বাংলাদেশের ভূমিকা মাইলফলক ছুঁতে চলেছে, অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে নজরকাড়া সাফল্য দেখা দিচ্ছে, চার লেন মহাসড়ক-উড়ালসড়ক যখন আর স্বপ্ন নয়, সব ক্ষেত্রে যখন ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পর যখন রফতানির কথা ভাবছে, ঠিক তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) আমাদের এক দুঃস্বপ্নের ভেতরে ঠেলে দিয়েছে। যাকে নিয়ে আমরা সব সময় গর্ব করেছি, নতুন নতুন স্বপ্নের জাল বুনেছি, সেই বিদ্যাপীঠের এই করুণ পরিণতি আমাদের চিন্তা ও চেতনাকে কেবল বিপর্যস্তই করেনিÑ আমরা মর্মাহত হয়েছি। বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাবি তার স্থান করে নিতে পারেনি। অথচ একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশনের প্রকাশিত সর্বশেষ র্যাংকিংয়ে বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ৯২টি দেশের ১ হাজার ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এক হাজারেরও পরে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় কতটা উন্নত, তা নির্ভর করে শিক্ষার পরিবেশ ও গবেষণার ওপর। আন্তর্জাতিক যোগাযোগও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তবে একসময় ঢাবির এ যোগ্যতা ছিল, এখন নেই। কিন্তু কেন! কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বিদ্যাপীঠের কয়েকজন খ্যাতিমান শিক্ষক বলেছেন, ভোটের রাজনীতির জন্য শিক্ষকরা পদোন্নতির ধাপগুলো অনেক সহজ করে ফেলেছেন। এ ক্ষেত্রে আগে গবেষণা ও প্রকাশনার একটা বাধ্যবাধকতা ছিল। সেটা এখন নেই বললেই চলে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট, শিক্ষা ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশের অভাব, ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতিকে দায়ী করেছেন একজন। তিনি বলেছেন, শিক্ষা খাতে সামগ্রিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদনের ৬ শতাংশ আর উচ্চশিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ থাকতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বর্তমানে যে প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করছে, এটি শিক্ষা-গবেষণার অনুকূল নয়।
পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাংকিংটি নির্ধারণ করে। এক. শিক্ষার পরিবেশ (টিচিং), গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম (বিসার্চ), গবেষণার উদ্ধৃতি (সাইটেশন), এ খাত থেকে আয় (ইনডাস্ট্রি ইনকাম) ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ (ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক)। আলাদাভাবে প্রতিটি সূচকের স্কোর বিবেচনায় নিয়ে একটি সামগ্রিক স্কোর নির্ধারণ করা হয়। আর সেই স্কোরের ভিত্তিতে তালিকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ স্থান করে নেয়। এই র্যাংকিংয়ে ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ছয় থেকে আটশোর মধ্যে। দুবছর পর অবস্থান আরো নিচের দিকে নেমে ২০১৮ সালে যা এক হাজারের পরে এসে দাঁড়ায়। ক্রমেই পিছিয়ে পড়ার এ এক নিকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। ফিরে পেতে চাই আমাদের অতীত ঐতিহ্য। আর এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সততার। দল-মত-নির্বিশেষে শিক্ষক, ছাত্র এবং সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সততার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। আবার নতুন করে সংশ্লিষ্ট সবার মনোজগতে নৈতিকতার বৃক্ষরোপণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ মুহূর্তে আমরা একটি ব্ল্যাকহোলের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। যেখানে প্রবেশের পর বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ থাকে না।
"