সাধন সরকার

  ২৬ আগস্ট, ২০১৯

মুক্তমত

জলাধার ও দেশি মাছের সুরক্ষা

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ হিসেবে আমাদের বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। গ্রামগঞ্জে আগে মাছ বললেই দেশি মাছ বোঝাত। বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে একসময় ছোট-বড় সব ধরনের জলাশয়ে ব্যাপক দেশি মাছের উৎপাদন হতো। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন ধরনের দেশি মাছ শহরের মানুষেরও চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করা হতো। দেশি মাছ স্বাদে ও গুণে অনন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশি মাছের উৎপাদন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। অনেক দেশি মাছ ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে! সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ১০০ প্রজাতির বেশি দেশি মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এক তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৫০ প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ তথা দেশি মাছ, বাকি ৪৫০ প্রজাতির মাছ সামুদ্রিক। জেলে, চাষাবাদ করে থাকে এমন চাষিদের ছোট ছোট উদ্যোগে দেশে বছরে প্রায় ১৬ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরণ করা এসব মাছের বেশির ভাগই দেশি প্রজাতির। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ‘আইইউসিএন’ ২০০০ সালের জরিপে বাংলাদেশের দেশি মাছের ৫৪ প্রজাতির মাছকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করে। একই সংস্থার ২০১৫ সালের জরিপে এই বিপন্ন মাছের তালিকায় আরো ৬৫ প্রজাতি যুক্ত হয়। সম্প্রতি মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিস, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদফতরের পৃথক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশি প্রজাতির প্রায় ৯১টি মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব মাছের মধ্যে রয়েছে পাঙাশের দুটি, গুতুমেদুধুটি, চেলার সাতটি, ডানকিনার দুটি, ঘরপোইয়াদুধুটি, মহাশীরের তিনটি, পুঁটির ১০টি, ভোলের দুটি ও ট্যাংরার ছয়টি প্রজাতি। কয়েক বছর আগে কিছু কিছু মাছের প্রজাতি বিলুপ্তি হয়ে গেলেও বা বিলুপ্তির পথে ১০০-এর বেশি দেশি মাছ থাকলেও এখনো কোনো মাছকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়নি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ‘আইইউসিএনের’ এ-সংক্রান্ত নিয়মটি হচ্ছেÑ সর্বশেষ কোনো একটি মাছের দেখা পাওয়ার পর পরবর্তী ২৫ বছরে যদি সেই প্রজাতির মাছের কোনো অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া না যায়, তাহলে সেটিকে বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে দেশি প্রজাতির মাছের মধ্যে কিছু প্রজাতি ‘প্রায় বিলুপ্ত’ অবস্থায় রয়েছে। কোনো কোনো প্রজাতি মহাবিপন্ন ও সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।

একসময় এ দেশে গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান আর নদীভরা মাছ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি-পরিবেশ বিনষ্ট, জলাশয় ধ্বংস আর মানুষের বিভিন্ন অসচেতনতামূলক কর্মকান্ডের কারণে দেশি মাছের প্রজাতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। মাছের বিচরণ এলাকা হিসেবে পরিচিত নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও খাল-বিল দূষিত হয়ে পড়ছে। নদীর তীর দখল, খাল-বিল ভরাট করে ফেলা, নদী বা বিলের মধ্যে বাঁধ দেওয়া, অপরিকল্পিতভাবে খাল-পুকুর খনন, ডিমপাড়ার মৌসুমে মাছ আহরণ, কৃষিকাজে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ, বিদেশি মাছের আগ্রাসন, পলি পড়ে নদী ও জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়াসহ দেশি মাছের প্রজাতি ধ্বংসের আরো কারণ রয়েছে। রাজধানীর চারপাশের নদ-নদীগুলোও প্রায় মাছশূন্য অবস্থা! কেননা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদীতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয় মাত্রা নেই বললেই চলে! শিল্প-কারখানার বর্জ্যে নদ-নদী দূষণ হওয়াসহ কৃষিজমির কীটনাশক কোনো না কোনোভাবে জলাভূমিতে গিয়ে পড়ে। আবার এ পর্যন্ত দেশে ৩০টির বেশি আগ্রাসী প্রজাতির বিদেশি মাছ ঢুকে পড়েছে। এসব বিদেশি মাছ আবার ছোট ছোট দেশি মাছ খেয়ে দেশি মাছের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। হাইব্রিডের আগ্রাসনে এখন গ্রামীণ জনপদগুলোতেও দেশি মাছের উৎপাদনে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। কৃত্রিমভাবে ব্যাপক পরিসরে চাষ করা হচ্ছে বিদেশি মাছ। যদিও স্বাদ ও পুষ্টিমান বিচারে বিদেশি মাছের চেয়ে দেশি মাছ অনেক এগিয়ে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশে^ প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। দেশি মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার মানে হলো সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়া। কারণ আমাদের আমিষের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ হয়ে থাকে মাছ থেকে। আবার গ্রামীণ মানুষের আয়-রোজগারের একটি বড় অংশ হচ্ছে মাছ ধরা। মাছ রফতানি করে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করে। এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১৩ লাখেরও বেশি জেলে সরাসরি মাছ আহরণে জড়িত। মাছের উৎপাদন যে করেই হোক বিশেষ করে দেশি মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কোনো মাছকেই বিলুপ্ত হয়ে দেওয়া যাবে না। সব ধরনের জলাশয়সহ দেশি মাছের বিচরণ ক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। দেশি মাছ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। সরকার ইলিশ রক্ষায় যেভাবে অভয়াশ্রম ঘোষণা ও প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে; দেশি প্রজাতির মাছকে রক্ষা করতে একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। নদ-নদীর দখল, দূষণ বন্ধ করতে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতাসহ দেশি মাছ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। দেশি মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে। সব ধরনের জলাশয় রক্ষা করে দেশি মাছ রক্ষা করা গেলে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় থাকবে।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close