এস এম মুকুল

  ২৪ আগস্ট, ২০১৯

প্রকৃতিপাঠ

বৃক্ষরোপণের প্রবণতা বাড়ছে

দেশের মানুষের মধ্যে বৃক্ষরোপণ প্রবণতা বাড়ছে। পরিবার পর্যায়ে যত গাছপালা রোপণ করা হয়, এর মধ্যে শুধু বসতবাড়ির আশপাশেই অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ গাছ লাগানো হয়। মানুষের গাছ লাগানোর জন্য উৎসাহকে পুঁজি করে শত-সহস্র নার্সারি গড়ে উঠেছে। অনেক পরিবারের জন্য শুধু নার্সারি আয়ই জীবিকার প্রধান উৎস। তবে পারিবারিক বৃক্ষরোপণের পুরো সম্ভাবনাকে এখনো কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। জানা গেছে, প্রায় সাড়ে ২০ লাখ পরিবার বৃক্ষরোপণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। গড়ে একটি পরিবারের পাঁচ সদস্য ধরা হলে মাত্র সোয়া কোটির মতো মানুষ বৃক্ষরোপণ করে। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা খুবই কম। তবে বৃক্ষরোপণে সরকারের প্রচেষ্টার প্রতিফলন যথেষ্ট না হলেও লক্ষণীয়। সরকার শিক্ষার্থীদের মাঝে বৃক্ষরোপণের প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। এই চেষ্টা আরো জোরদার হওয়া দরকার। প্রতি শিক্ষাবর্ষে বৃক্ষরোপণের ওপর শিক্ষার্থীদের নম্বর দেওয়া যেতে পারে। ক্যাম্পেইন প্রয়োজন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে। শিক্ষার্থীদের জন্য নামমাত্র মূল্যে গাছের চারা বিতরণ করা যেতে পারে। বছরে তিনটি করে গাছ লাগালে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনেই এর সুফল ভোগ করবে। এই গাছ লাগানো তাদের শুধু ব্যক্তিগতভাবে লাভবান করবে না; পরিবেশ বাঁচাবে, প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে উঠবে তারা। এ ক্ষেত্রে চীনের উদ্যোগটি অনুসরণীয় হতে পারে। গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা নিতে এবং জীবনযাত্রার পার্থক্য অনুধাবনের জন্য চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চংকিং শহর কর্তৃপক্ষ শহরের শিক্ষার্থীদের গ্রামে পাঠায়। গ্রামে অবস্থানের সময় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ শিক্ষার্থীর প্রত্যেককেই ১০০টি করে চারা গাছ রোপণ করতে হয়। তাদের ধারণা, এসব শিক্ষার্থীর জীবনবোধ হবে মানবীয়, প্রজন্মগত ও ভৌগোলিক দূরত্ব কমানো সম্ভব হবে।

গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময় : জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে নিকটস্থ জেলা ও উপজেলার নার্সারি বা বৃক্ষমেলা থেকে চারা সংগ্রহ কিনে আপনিও ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা লাগান। সরকারের উদ্যোগে গাছ লাগানোর সুযোগ রয়েছে প্রচুর। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সরকারি অফিস, খাসজমি, রাস্তার দুই পাশে, নদীর দুই পারে, রেল সড়কের দুই পাশে এবং উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর গাছ লাগানোর সুযোগ আছে। হাওরে পানিসহিষ্ণু হিজল ও করচগাছ লাগিয়ে বাগ বা জঙ্গল তৈরি করা যেতে পারে। রাজধানী ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন, পৌর শহর, উপজেলা বা থানা পর্যায়ে শহরের ভেতরে রাস্তার মাঝখানে ডালপালা কম হয়, উঁচু ও দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগালে পাঁচ বছরে আমাদের শহরগুলোও সবুজ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের বসতবাড়ি এক একটি অপরিকল্পিত বহুস্তর বিশিষ্ট ফলদ বৃক্ষ চাষ ক্ষেত্র। বহুস্তর বিশিষ্ট দেশীয় প্রচলিত ফল বাগানের বড় স্তরে আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল, তাল, খেজুর ইত্যাদি বৃক্ষ, মধ্যম স্তরে পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি এবং নিচের স্তরে আনারস ইত্যাদি চাষ করা লাভজনক। প্রকৃতি এবং এলাকার মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য অনুসারে উন্নত জাতের মানসম্মত সুস্থ চারা বা কলম রোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে বহুস্তর বিশিষ্ট ফল চাষ করলে উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব। ফলদ বৃক্ষের উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী বাগান স্থাপন, মাঠদিবস, ফল গ্রাম, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা করতে ফলদ বৃক্ষের উন্নত জাতের চারা বা কলম সংগ্রহ, রোপণ, সার, পানি, ওষুধ প্রয়োগ, আগাছা দমন, অঙ্গ ছাঁটাই ইত্যাদি পরিচর্যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে করা দরকার। বাজারজাতকরণ আধুনিকায়ন করতে চারা বা কলম নির্বাচনে এ দেশে ৮০ প্রজাতির প্রচলিত ও অপ্রচলিত দেশজ ফলদ বৃক্ষকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে।

পেরুর আন্দেস পর্বতে প্রাচীন ইনকা সভ্যতার সময় প্রকৃতি সংরক্ষণের যে উদ্যোগ দেখা যেত, বিগত শতাব্দীতে তা সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। এ কারণে গাছপালা, জঙ্গল ধ্বংসের প্রবণতা বন্ধ করতে একদল মানুষ নতুন উদ্যোগ শুরু করেছেন। পেরুর আন্দেস পর্বতে বার্ষিক কেনা রায়মি নামের বৃক্ষরোপণ উৎসবে বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ২০০ মানুষ সপরিবারে চারাগাছ, যন্ত্রপাতি, রসদ নিয়ে প্রায় ৪ হাজার মিটার উচ্চতায় বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম শুরু করেছে। জানা যায়, কয়েক শতাব্দী ধরে গাছ কাটার ফলে প্রায় সব জঙ্গল সাফ হয়ে গেছে। নতুন করে গাছ লাগানোও হয়নি। এই প্রথম গ্রামের অন্যতম বয়স্ক এক মানুষ হিসেবে এরমোগেনেস কিসপে সপরিবারে এই উদ্যোগের অংশ হয়েছেন। আধিবাসীদের ধারণা, গাছপালা না থাকলে পাহাড় থেকে পানি সরাসরি উপত্যকায় বয়ে যায়। ফলে ভূমিধসের আশঙ্কা থাকে। তারপর পানি সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। আমরা নতুন গাছ লাগাচ্ছি, যা প্রকৃতির সৃষ্টি করা আর্দ্রতা অর্থাৎ বৃষ্টি ও কুয়াশা শুষে নিতে পারে। গাছপালাই পানি জমা করার একমাত্র পথ।

গাছ মানুষের এত উপকার করার পরও অকাতরে চলছে বৃক্ষ নিধন। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, আসবাবপত্র তৈরি, শিল্পের কাঁচামাল তৈরি, জ্বালানি কাঠের সরবরাহÑ এসব অজুহাতে গাছ কেটে বনভূমি উজাড় করছি আমরা। আর এর ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মেনো-অক্সাইড, লিথেনসহ ক্ষতিকর গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমন্ডল দূষিত হচ্ছে। তবে আশার খবরটি হচ্ছেÑ সবুজ বনভূমি ও বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা, আগ্রহ এবং বৃক্ষরোপণ প্রবণতা বাড়ছে। এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গ্রামের মানুষ এখন গাছকে তার ‘সামাজিক বিমা’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তাই গাছের ফল, জ্বালানি, পরিবেশগত সুবিধা এবং গাছের আর্থিক অবদানের জন্য বৃক্ষরোপণের প্রতি মানুষ উৎসাহিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে নতুন প্রকল্প গ্রহণকালে প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টি ও তা সংরক্ষণ এবং অধিক হারে বৃক্ষরোপণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এটাও লক্ষ রাখতে হবে, যেকোনো প্রকল্পের সঙ্গে বৃক্ষরোপণ করতেই হবে এবং জলাধার সৃষ্টি এবং জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বনবিভাগ উপকূলে নতুন জেগে ওঠা চরসহ ফাঁকা জমিতে গাছ লাগানোর বিষয়টিকে দেশে জনপ্রিয় করে তুলতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। যার ফলে বনের বাইরেও গ্রামের মানুষ বাড়ির চারপাশে, পতিত জমিতে, পুকুর ও নদীর পাড়ে, ফসলের জমির আইলে বৃক্ষরোপণ করছে। বিশেষত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে ফলবাগান করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। একই সঙ্গে বনবিভাগ ও গ্রামীণ জনগণের যৌথ উদ্যোগে সামাজিক বনায়নের পরিধিও বাড়ছে। বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদফতরসহ পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের প্রচেষ্টায় বৃক্ষের প্রতি মানুষের দরদ লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বৃক্ষমেলার আয়োজন তারই প্রতিফলন। আবার সারা দেশের শহরাঞ্চলের বাড়ির ছাদে, বারান্দা, করিডর এমনকি জানালার কার্নিশে ফল, ফুল, ভেষজ গাছ লাগানোর পরিমাণ বেড়েছে। আরো আশাবাদের বিষয় হলোÑ শহরের মানুষ শৌখিনতায় হলেও ঘরের ভেতরে ছায়া উপযোগী বৃক্ষের শোভায় গৃহসজ্জায়ন করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতার সুফল মানুষই ভোগ করবে।

তবে আশার কথা হচ্ছেÑ দেশে প্রাকৃতিক বনভূমি যখন সংকুচিত হয়ে আসছে, তখন এর বিপরীত প্রবণতায় বনের বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণও ক্রমেই বাড়ছে। পরিবেশবিদদের মতে, বৃক্ষের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক মূল্য, কমিউনিটি উদ্যোগ এবং সরকারের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির ফলে লোকালয়ে গাছের সংখ্যা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বনবিভাগের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বনের বাইরে নতুন করে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বেড়েছে। সামাজিক বনায়নের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ার ফলে সবুজায়নের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষায় এটি অবশ্যই আশাবাদের সঞ্চার করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বনের বাইরে ও ভেতরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার সমন্বিত মূল্যায়ন : ২০০০ থেকে ২০১৪’ শীর্ষক ওই গবেষণাটির একটি সারসংক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের আইওপি সায়েন্স নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, ৫০ বছর বয়স্ক একটি ফল গাছ তার সারাজীবেন মানুষের যে উপকার করে তার আর্থিক মূল্য ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। আবার পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, সুস্বাস্থ্যের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু প্রয়োজন ও প্রাপ্তির ব্যবধানের কারণে আমরা মাত্র ৪০-৪৫ গ্রাম ফল খেতে পারছি। অপরপক্ষে যদি ফলদ বৃক্ষরোপণ করে আমরা সমৃদ্ধ ফলবাগান গড়ে তুলতে পারি; তাহলে আমরা দেশীয় ফল থেকে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারব। এজন্য আমাদের বেশি বেশি ফলের গাছ লাগাতে হবে। ফলদ বৃক্ষ পরিবেশ রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার ওষুধ তৈরির জন্য ভেষজ গাছের প্রয়োজন। তাই বনজ ও ফলদ গাছের

পাশাপাশি ভেষজ গাছও লাগাতে হবে। পরিবেশকে শুদ্ধ, নির্মল ও সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজন প্রকৃতির আলিঙ্গনে নিজেকে সমর্পণ করা। আমরা প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির কোলেই আমরা বেড়ে উঠি। সুতরাং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে প্রকৃতিকে ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। আসুন, সবার আগে বৃক্ষকে ভালোবাসতে শিখি।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close